ত্বকের যত্ন নেওয়ার আগে জেনে নিন আপনার প্রোডাক্টে কী আছে! বর্তমানে স্কিন কেয়ারের জগতে ‘প্যারাবেন ফ্রি’ শব্দটি বেশ আলোচিত। অনেক ব্র্যান্ডই তাদের প্রোডাক্টে বড় অক্ষরে লিখে রাখে “Paraben-Free” বা “No Harmful Preservatives”। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্যারাবেন আসলে কী? এটি কেন অনেক স্কিন কেয়ার ব্র্যান্ড বাদ দিচ্ছে? এবং প্যারাবেন ফ্রি প্রোডাক্ট ব্যবহারে কী কী উপকারিতা রয়েছে?
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত জানব প্যারাবেন সম্পর্কে, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, এবং কেন প্যারাবেন ফ্রি প্রোডাক্টকে নিরাপদ ধরা হয়।
প্যারাবেন কী?
প্যারাবেন এক ধরনের রাসায়নিক সংরক্ষণকারী উপাদান (Preservative) যা প্রসাধনী ও ব্যক্তিগত যত্নের পণ্যে ব্যবহার করা হয় ছাঁচ, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের বৃদ্ধি রোধ করার জন্য। এর মাধ্যমে একটি প্রোডাক্ট অনেক দিন ভালো থাকে এবং নষ্ট হয় না।
সাধারণত নিচের কয়েকটি ধরনের প্যারাবেন বেশি ব্যবহৃত হয়:
মিথাইলপ্যারাবেন (Methylparaben)
প্রোপাইলপ্যারাবেন (Propylparaben)
বুটাইলপ্যারাবেন (Butylparaben)
ইথাইলপ্যারাবেন (Ethylparaben)
এগুলো সাধারণত শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, ফেসিয়াল ক্লিনজার, বডি লোশন, মেকআপ এবং এমনকি কিছু ওষুধেও ব্যবহৃত হয়।
প্যারাবেন নিয়ে কেনো এতো বিতর্ক?
প্যারাবেন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় যখন কিছু গবেষণায় দেখা যায়, এটি মানবদেহের হরমোন সিস্টেমে প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে ইস্ট্রোজেন হরমোন অনুকরণ করতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়। ইস্ট্রোজেনের মাত্রা মূলত বেড়ে গেলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে এমন আশঙ্কা থেকেই এটি বিতর্কের কেন্দ্রে আসে।
কিছু গবেষণার পাওয়া গেছে,
২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ রেডিং-এর গবেষক Dr. Philippa Darbre এর নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় স্তন ক্যানসার আক্রান্ত নারীদের টিস্যুতে প্যারাবেনের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
তবে এই গবেষণা সরাসরি প্রমাণ দেয়নি যে প্যারাবেন ক্যানসারের কারণ, বরং এটি উপস্থিত ছিল যা কেবল সন্দেহের জন্ম দেয়।
FDA এবং WHO কী বলছে?
FDA (মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন) এখন পর্যন্ত প্যারাবেনকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেনি, তবে তারা গবেষণা পর্যবেক্ষণ করছে।
EU (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন) কিছু নির্দিষ্ট প্যারাবেন যেমন বুটাইলপ্যারাবেন ও প্রোপাইলপ্যারাবেনের ব্যবহারে সীমা নির্ধারণ করেছে এবং শিশুদের পণ্যে নিষিদ্ধ করেছে।
প্যারাবেন ফ্রি স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট কেনো বেছে নিবেন?
১. হরমোন ভারসাম্যহীনতা থেকে নিরাপত্তা
প্যারাবেন শরীরের হরমোনের স্বাভাবিক ভারসাম্য বিঘ্নিত করতে পারে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা করেন। বিশেষত মহিলাদের মধ্যে এটি PCOS, মাসিক অনিয়ম বা ত্বকে হরমোন-নির্ভর একনে এর ঝুঁকি বাড়াতে পারে। প্যারাবেন ফ্রি প্রোডাক্ট এই সম্ভাব্য হুমকি থেকে নিরাপদ রাখতে সাহায্য করে।
২. ত্বকে অ্যালার্জির ঝুঁকি কম
অনেকের ত্বক প্যারাবেনকে সহ্য করতে পারে না। এতে চুলকানি, র্যাশ, লালচে ভাব, এমনকি একজিমার মত সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে সংবেদনশীল ত্বক (sensitive skin) বা শিশুদের ত্বকে এসব সমস্যা বেশি দেখা যায়।
৩. দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে কম ঝুঁকি
ত্বকের পণ্য প্রতিদিন ব্যবহার করা হয়। ফলে প্রোডাক্টে থাকা ক্ষতিকর উপাদান ধীরে ধীরে শরীরে জমতে পারে। প্যারাবেন ফ্রি পণ্য দীর্ঘমেয়াদে নিরাপদ বলে বিবেচিত।
৪. গর্ভবতী ও শিশুর জন্য নিরাপদ পছন্দ
অনেক চিকিৎসক পরামর্শ দেন গর্ভবতী নারীরা যেন প্যারাবেনযুক্ত প্রসাধনী ব্যবহার না করেন, কারণ এটি ভ্রূণের উপর সম্ভাব্য প্রভাব ফেলতে পারে। তাই মা ও শিশু উভয়ের জন্য প্যারাবেন ফ্রি প্রোডাক্টই নিরাপদ বিকল্প।
৫. নতুন প্রাকৃতিক ও হালাল ট্রেন্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ
বর্তমান যুগে অনেকেই ভেগান, হালাল, অর্গানিক স্কিন কেয়ারের দিকে ঝুঁকছেন। এসব ব্র্যান্ড প্রায় সবসময় প্যারাবেন ফ্রি হয়। তাই আপনি যদি পরিবেশবান্ধব বা ধর্মীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য স্কিন কেয়ার চান, তাহলে প্যারাবেন ফ্রি প্রোডাক্টই যুক্তিসঙ্গত।
কীভাবে বুঝবেন কোন প্রোডাক্ট প্যারাবেন ফ্রি?
বাজারে এখন অনেক প্রোডাক্ট রয়েছে যেগুলো ‘প্যারাবেন ফ্রি’ দাবি করে। তবে আপনি নিজেই নিচের উপায়গুলো অনুসরণ করে যাচাই করতে পারেন প্রোডাক্টটি প্যারাবেন ফ্রি কিনা :
লেবেল পড়ুন:
প্রোডাক্টের পেছনে লেখা Ingredients List লক্ষ্য করুন। নিচের কোনো উপাদান থাকলে বুঝবেন তাতে প্যারাবেন রয়েছে:
*Methylparaben
*Propylparaben
*Butylparaben
*Ethylparaben
*Isobutylparaben
সার্টিফিকেট বা লোগো চেক করুন:
‘Paraben Free’, ‘No Harmful Preservatives’, ‘Dermatologically Tested’, ‘Sensitive Skin Friendly’ এসব ট্যাগ বা সীল দেখে নিতে পারেন।
ভরসাযোগ্য ব্র্যান্ড বেছে নিন:
বিশ্বের স্বনামধন্য অনেক ব্র্যান্ড এখন প্যারাবেন ফ্রি প্রোডাক্ট তৈরি করছে। যেমন:
The Ordinary
*Cetaphil
*CeraVe
*Aveeno
*Bioderma
*Mamaearth
*Minimalist (India)
বাংলাদেশেও এখন অনেক দেশীয় ব্র্যান্ড যেমন Skin Cafe, Organikaon, Maya ইত্যাদি প্যারাবেন ফ্রি প্রোডাক্ট বাজারে এনেছে।
প্যারাবেনের বিকল্প হিসেবে কী ব্যবহার করা হয়?
নতুন প্রযুক্তি ও গবেষণার মাধ্যমে বর্তমানে অনেক নিরাপদ বিকল্প সংরক্ষণ উপাদান ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন:
*Phenoxyethanol
*Potassium Sorbate
*Sodium Benzoate
*Ethylhexylglycerin
এসব বিকল্প তুলনামূলকভাবে কম প্রতিক্রিয়াশীল এবং নিরাপদ বলে মনে করা হয়।
প্যারাবেন সম্পূর্ণ খারাপ নয়?
যদিও প্যারাবেনের বিরুদ্ধে অনেক মতভেদ রয়েছে, কিছু গবেষক মনে করেন নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে প্যারাবেন ব্যবহারে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। তবে যেহেতু এটি নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে এবং সংবেদনশীল ত্বকে সমস্যা দেখা দিতে পারে তাই সচেতনতা এবং সাবধানতা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
নিজের ত্বককে ভালোবাসুন, সচেতন থাকুন
ত্বকের যত্ন মানেই শুধু বাইরের সৌন্দর্য নয়, এটি একটি স্বাস্থ্যগত বিষয়। আপনি প্রতিদিন যে স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করছেন, তা নিরাপদ কিনা তা জানা আপনার অধিকার।
‘প্যারাবেন ফ্রি’ মানে কেবল ট্রেন্ড নয় এটি একটি সচেতন, স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ লাইফস্টাইলের অংশ।
তাই পরবর্তীবার আপনি কোনো ফেসওয়াশ, সিরাম, বা লোশন কিনতে গেলে, একটু সময় নিয়ে ইনগ্রেডিয়েন্ট লিস্টটি দেখে নিন। আপনার ত্বককে উপহার দিন নিরাপদ স্পর্শে স্বচ্ছ ও কোমল ত্বক।
Leave a comment