শীতে নিয়ম মেনে থাকুন সুস্থ

প্রকৃতির পাতা উল্টিয়ে চলে এসেছে শীত। জানালা খুললেই হু হু করে উত্তরীয় হাওয়া ঢুকে পড়ছে ঘরে। আমরাও খোঁজ করছি নরম নরম রোদের। এই শীত আসার সাথে সাথে বাড়তে থাকে নানা রোগও। হয়তো খুব বড় কিছু নয় তবে ঠান্ডা, সর্দি, কাশি, ফ্লু তে প্রায় সবাই ভুগে থাকেন। ছোট থেকে বড় সবাই এ ধরনের রোগগুলোতে কষ্ট পেয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা যদি অল্প কিছু নিয়ম মেনে চলতে পারি তাহলে হয়তো এ ধরনের রোগগুলো থেকে বেঁচে যেতে পারি। চলুন আজকে আমরা ঘরোয়া কিছু উপায় জেনে নিই এ সমস্যাগুলো থেকে বাঁচার জন্য।

 

শীতের সাধারণ সমস্যাঃ

 

  • ঠান্ডা ও সর্দি
  • কাশি
  • ফ্লু
  • সাইনোসাইটিস
  • গলা ব্যথা
  • নিউমোনিয়া
  • ড্রাই স্কিন

 

সুস্থ থাকতে করণীয়ঃ

 

সাধারণ সমস্যা তো আমরা জানলাম, তবে এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? উপায় অবশ্যই আছে। কিছু নিয়ম, ঘরোয়া দাওয়াই এ ধরনের ছোটখাটো কষ্ট ভালোভাবে দূর করতে পারে। তবে কথা না বাড়িয়ে চলুন জেনে নিই এসব থেকে বেঁচে থাকার উপায়।

 

১। নিয়মিত খান চিকেন স্যুপঃ

 

চিকেন স্যুপ আমাদের অনেকেরই বেশ প্রিয় খাবার। বিশেষত বাচ্চারা এটি খেতে বেশ পছন্দ করে। মজার ব্যাপার হলো চিকেন স্যুপ কিন্তু এই শীতে আপনাকে নানারকম রোগ থেকেও বাঁচাতে পারে। চিকেন স্যুপের মাঝে থাকা উপাদান আপনার ইমিউন সিস্টেমকে স্ট্রং করে। এছাড়া এটি আপনার শরীরকে হাইড্রেট করে। যেহেতু শীতকালে আমরা এমনিই পানি একটু কম পান করি, তাই স্যুপ অনেকটাই আমাদের শরীরের পানির চাহিদাও পূরণ করতে পারে। চিকেন স্যুপের পুষ্টি উপাদানগুলো শরীরের সেল এ থাকা শ্বেত রক্তকণিকার চলাচল ধীরগতির করে তোলে ফলে যেখানে শ্বেত রক্তকণিকার প্রয়োজন সেখানে এগুলো জড়ো হয়। শ্বেত রক্তকণিকা রক্তে থাকা ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করে। স্যুপের মাঝে চিকেন, গাজর, নানা ধরনের সবজী, চিকেন বোন বা ব্রোথ (হাড়ের ঝোল) দিতে পারেন। চিকেন বোনের মাঝে থাকা ক্যালসিয়ামও শরীরের নানা উপকার করে। তাই হিম হিম ঠান্ডায় উষ্ণ এক বাটি চিকেন স্যুপ হতে পারে আপনার সুস্থ থাকার জন্য এক দারুণ খাবার। তবে যদি ক্যান অথবা প্যাকেটজাত রেডিমেড স্যুপ ব্যবহার করেন সেক্ষেত্রে সোডিয়াম কম আছে এমন স্যুপই বেছে নিন।

 

২। আদা রাখুন নিত্যদিনঃ

 

ছোটকালে আমাদের সর্দি-কাশি বা ঠান্ডা লাগলেই নানী দাদী অথবা মায়েরা আদা চা করে দিত না? এখনো আমরা এ ধরনের সমস্যায় আদা চা পান করি। আসলেই আদা কিন্তু এ সব সমস্যার জন্য বেশ উপকারী। ২০১৫ সালের কোপেনহেগেন, ক্যালিফোর্নিয়াসহ কয়েকটি ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় প্রকাশ করা হয় যে আদায় রয়েছে ভরপুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল ও অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরী উপাদান যা বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। ফলে গলা ব্যথা, ঠান্ডা ও সর্দির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মাসল পেইন কমিয়ে থাকে আদা। নাক বন্ধ থাকলে আদা খেলে সেটি থেকেও পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এছাড়া আদা হজম শক্তিও বৃদ্ধি করে। তাই শীতের দিনে নিয়মিত পান করতে পারেন আদা চা। গরম পানিতে আদা সেদ্ধ করে রস করে নিয়ে তার মাঝে মধু ও লেবুর রস বানিয়ে উষ্ণ এই পানীয়টিও পান করতে পারেন। নিয়মিত আদা খেয়ে খুব সহজেই শীতের এই সাধারণ সব সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। 

 

৩। ডায়েটে যোগ করুন মধুঃ

 

মধুর উপকারীতা কমবেশি সবাই আমরা জানি। মধু নিয়মিত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ভালো, তেমন এটি শীতকালের এই সাধারণ সমস্যাগুলো থেকেও আপনাকে দিবে অনেকটাই মুক্তি। বিভিন্ন নিউট্রিয়েন্টস এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এ ভরপুর এই উপাদানটি চিনির সাবস্টিটিউট হিসেবে অনেকেই খেয়ে থাকেন। ২০০৭ সালে আর্কাইভস অফ পেডিয়াট্রিক্স অ্যান্ড অ্যাডলেসেন্ট মেডিসিনে প্রকাশিত একটি রিসার্চে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বাচ্চাদের রাতে ঘুমানোর আগে মধু খাওয়ালে কাশি কমে যায় এবং নিয়মিত দিলে সেরে যায়। তাছাড়া তাদের শরীর উষ্ণ থাকে এবং ভালো ঘুম হয়। এছাড়া বুকে কফ জমা, গলাব্যথা এগুলো থেকে মুক্তি দিতেও মধু বেশ ভালো কাজ করে। আর মধুর সাইড ইফেক্টও নেই। তাই শীতে নিজেকে সুস্থ ও উষ্ণ রাখতে নিয়মিত খেতে পারেন মধু। এক চামচ মধু প্রতিদিন ঘুমানোর আগে অথবা উষ্ণ গরম পানিতে মিশিয়ে পান করতে পারেন সকালে বা রাতে। বাচ্চাদেরকেও সুস্থ রাখতে রাতে ঘুমানোর আগে দিতে পারেন মধু।

 

৪। কাশি ও গলাব্যথা দূর করুন লবণ পানির গার্গলঃ 

 

শীতকালের সবচেয়ে সাধারণ একটি সমস্যা হলো গলাব্যথা ও কাশি। গরম বা উষ্ণ গরম পানিতে লবণ দিয়ে গার্গল এই সমস্যার সবচেয়ে সাধারণ ও বহুল প্রচলিত সমাধান। গবেষণায়ও প্রমাণ পাওয়া গেছে যে লবণ পানির গার্গল ব্যাক্টেরিয়া দূর করে, গলায় জমে থাকা মিউকাস দূর করে। কিছু ক্ষেত্রে সাইনাস, টনসিল এসবেরও উপশম করে থাকে লবণ পানির গার্গল। এছাড়া দাঁত ভালো রাখতে এবং মাড়িতে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ থেকেও রক্ষা করে থাকে এই লবণ পানির গার্গল। এটি করা যেমন সোজা, তেমনই কাজের। এক গ্লাস পানিতে এক বা দেড় চামচ লবণ দিয়ে ভালোভাবে গুলিয়ে গার্গল করতে হবে যেন তা গলার ভেতর পর্যন্ত পৌঁছায়। এরপর এটিকে ফেলে দিন। এই ছোট একটি সহজ কাজ নিয়মিত করলে শীতে কাশি, গলাব্যথার মত উপসর্গগুলোকে খুব সহজেই এড়িয়ে যেতে পারবেন। 

 

৫। বন্ধ হওয়া নাক উপশমে উষ্ণ স্টিমঃ

 

নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া শীতের আরেকটি ঝামেলা এবং কষ্টকর সমস্যাগুলোর একটি। অনেকেই বন্ধ হওয়া নাক উপশমের জন্য ন্যাজাল ড্রপ ইউজ করতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে উষ্ণ স্টিম বেশ ভালো কাজ করে। একটি হাড়িতে পানি গরম করে, সেটির ধোঁয়া নাক দিয়ে টেনে ভেতরে নেয়াটাই স্টিম থেরাপি। এছাড়া উষ্ণ গরম পানিতে গোসল করলেও নাকে জমে থাকা মিউকাস গলে যায়, ব্যাক্টেরিয়া ও অন্যান্য জীবাণু দূর হয়। শীতকালে নিয়মিত তাই উষ্ণ গরম পানিতে গোসল করা উচিত।

 

৬। ব্যবহার করুন হিউমিডিফায়ারঃ

 

মূলত শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কমে যায়। যার ফলে আমাদের পরিবেশ হয়ে যায় আরো শুষ্ক। এজন্য ব্যবহার করুন হিউমিডিফায়ার। এটি ঘরের তাপমাত্রার প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফলে স্কিন ড্রাইনেস থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং শুষ্কতাজনিত কারণে যে সকল উপসর্গ দেখা যায় তা দূর হয়।  

 

৭। শাক-সবজি ও ফলমূল খান বেশি বেশিঃ

 

শীতে আপনার ইমিউন সিস্টেম যত বেশি শক্তিশালী হবে তত সুস্থ থাকতে পারবেন। তাই ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করতে নিত্যদিনের খাবারের মেনুতে যোগ করুন প্রচুর পরিমাণে ফলমূল ও শাক সবজি। ভিটামিন সি, মিনারেলস, জিংক এবং পানি সমৃদ্ধ খাবার এ সময় বেশি বেশি খেতে হবে। গাজর, মিষ্টি আলু, টমেটো, কমলালেবু, ব্রকলি, মটরশুটি, ফুলকপি ইত্যাদি শরীর ভালো রাখতে এবং ইমিউন সিস্টেম স্ট্রং করতে অনেক সাহায্য করে। 

 

৮। পর্যাপ্ত পানি পান করুনঃ

 

শীতকালে আমরা গরমকালের তুলনায় পানি কম পান করে থাকি। এ কারণে শীতকালে পানিশূণ্যতা সহ নানা রোগ দেখা দেয় শরীরে। বাতাসের আর্দ্রতা কমে যাওয়ায় বাইরের আবহাওয়া থেকেও আমাদের প্রয়োজনীয় পানি শরীর পায় না। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন। হাইড্রেটেড থাকলে ড্রাই স্কিন প্রবলেমও দূর হয়, ইমিউন সিস্টেম স্ট্রং হয়, বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণ থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। 

 

৯। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিনঃ

 

দেখা গেছে, শীতকালীন ঠান্ডাজনিত রোগগুলো যেমন- সর্দি, কাশি, ফ্লু ইত্যাদি পর্যাপ্ত বিশ্রামে দ্রুত সেরে ওঠে। তাছাড়া বিশ্রাম ঠিকমতো হলে ইমিউন সিস্টেমও স্ট্রং হয়। তাই এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে প্রচুর বিশ্রাম নিন। রাতে অন্তত আট ঘন্টা একটানা ঘুমিয়ে নিন। গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা যখন বিশ্রাম নিই তখন আমাদের শরীর ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে আরো ভালোভাবে ফাইট করতে পারে। তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলে এ ধরনের সাধারণ উপসর্গগুলো থেকে সহজেই রক্ষা পাওয়া যায়।

 

শীতে নানারকম মৌসুমী যে স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো দেখা দেয় তা একটু নিয়ম মেনে চললেই এড়ানো সম্ভব। এই নিয়মগুলো মানার পরও যদি সর্দি, কাশি বা ফ্লু সিভিয়ার পর্যায়ে চলে যায় তবে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন। বয়ষ্ক ও বাচ্চাদের ক্ষেত্রে একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন। তাছাড়া ঠান্ডা লাগা এড়াতে প্রয়োজনী সোয়েটার, হাত মোজা ,পা মোজা, মাফলার, মাস্ক ইত্যাদি ব্যবহার করুন ও সুস্থ থাকুন। সতর্ক থেকে উপভোগ করুন শীতের এই দারুণ সময়গুলো। 

Author