আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াতে বসে রিয়া খেয়াল করলো তার চুল বেশ পাতলা হয়ে গেছে। সাথে চুল পড়ছেও বেশ। রুক্ষ শুষ্ক এই চুলগুলো দেখে তার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। ভাবতে থাকলো এখন কী উপায়?
উপায় অনেক আছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খাদ্যাভ্যাস, স্কুল, কলেজ অথবা অফিসে যাতায়াত, ব্যস্ত রুটিনের ফাঁকে চুলের যত্নের জন্য কমে যাচ্ছে সময়। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে শখের চুলের সেই পুরোনো জৌলুস। চলুন আজকে তবে কিছু ঘরোয়া হেয়ার প্যাক ও মাস্ক সম্পর্কে জানি, যেগুলো আপনার চুলকে করে তুলবে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ও ঝকঝকে।
চুলের সমস্যাগুলো কী কী?
যত্নের অভাবে আমাদের চুলে আমরা নানাবিধ সমস্যা প্রতিনিয়ত ফেস করে থাকি। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হলো চুল পড়া ও খুশকি সমস্যা।
দৈনন্দিন ৫০ থেকে ১০০ টির মত চুল পড়া স্বাভাবিক, তবে এর বেশি চুল পড়তে থাকলে সেটি সমস্যা এবং এর জন্য চুলের প্রতি খেয়াল রাখা প্রয়োজন। এছাড়া নিয়মিত স্ক্যাল্প পরিষ্কার না করলে , এক্সফোলিয়েট না করলে, ময়লা, তেল ইত্যাদি স্ক্যাল্পে জমে অথবা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে হতে পারে খুশকি বা ড্যানড্রাফ সমস্যা। যার ফলে র্যাশ, স্কিন ইরিটেশন ইত্যাদি বেড়ে যায়। এছাড়াও চুল পাতলা হয়ে যাওয়া, স্প্লিট এন্ডস, চুল রুক্ষ শুষ্ক হয়ে যাওয়া, হেয়ার গ্রোথ না হওয়া এসব সমস্যাও হতে পারে নিয়মিত চুলের যত্ন না নেয়া হলে। তাই ব্যস্ত জীবনে অল্প একটু সময় করে ঘরে থাকা কিছু উপাদান দিয়েই হেয়ার প্যাক অথবা হেয়ার মাস্ক দিয়েই চুলের এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
ঘরোয়া উপাদানে চুলের যত্নঃ
১। হেয়ার গ্রোথ বাড়াতে ডিম, অলিভ অয়েল ও টক দইয়ের প্যাকঃ
সুন্দর, স্বাস্থ্যজ্জ্বোল ও ঘন চুল কে না চায়? যদি হেয়ার গ্রোথ বাড়াতে চান তবে ডিম, অলিভ অয়েল ও টকদই এর এই হেয়ার প্যাকটি দারুণ কার্যকরী। ডিম চুলের প্রয়োজনীয় প্রোটিন সরবরাহ করে চুলকে করে তোলে স্বাস্থ্যকর। এছাড়া ডিম চুলের গোড়াকে মজবুত করে চুলের বৃদ্ধি বাড়ায়। অলিভ অয়েল চুলের জন্য প্রয়োজনীয় তেল সরবরাহ করে স্ক্যাল্পকে ড্রাইনেস থেকে রক্ষা করে, চুলকে করে তোলে সফট ও শাইনি। টক দইয়ে রয়েছে অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল উপাদান যা স্ক্যাল্পে ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা করে এবং ড্যানড্রাফ হওয়া থেকে বাঁচায় ও ডেড স্কিন সেলস দূর করে।
যা যা লাগবেঃ
- ১ টি অথবা ২ টি ডিম (চুলের লেন্থ অনুযায়ী যেটুকু প্রয়োজন)
- ১ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল
- ১ কাপ টক দই অথবা চুলের লেন্থ অনুযায়ী যেটুকু প্রয়োজন
কীভাবে বানাবেন ও অ্যাপ্লাই করবেনঃ
- প্রথমে ডিম ও অলিভ অয়েল নিয়ে খুব ভালোভাবে ফেটিয়ে মিশিয়ে নিন।
- ডিম ও অলিভ অয়েলের মিশ্রণে টক দই মিশিয়ে একটি স্মুথ পেস্ট তৈরী করুন।
- পেস্ট পুরো স্ক্যাল্পে এবং চুলে ভালোভাবে মাখিয়ে নিন এবং ২০ মিনিটের মত অপেক্ষা করুন।
- এবার শ্যাম্পু দিয়ে চুল ভালোভাবে ধুয়ে কন্ডিশনার অ্যাপ্লাই করুন।
সপ্তাহে একদিন এই হেয়ার প্যাকটি মাত্র ২০ মিনিটের জন্য ব্যবহার করা শুরু করলে অল্প কিছুদিনের মাঝেই আপনি পার্থক্য বুঝতে পারবেন। একদমই ঘরোয়া এইসব উপাদান দিয়ে বানানো হেয়ার প্যাকটি অল্পদিনেই আপনার চুলের বৃদ্ধি বাড়িয়ে চুলকে আরো সুন্দর করে তুলতে সাহায্য করবে।
২। ড্যানড্রাফ তাড়াতে জবা ফুলের পাতা, মেথি ও টক দইয়ের প্যাকঃ
প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে জবার ব্যবহার হয়ে আসছে চুলের যত্নে। এটি চুলের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে এবং ড্যানড্রাফের বিরুদ্ধে লড়াই করে চুলের বৃদ্ধি বাড়ায়। এছাড়া স্ক্যাল্পের ইচিনেস, র্যাশ ইত্যাদি কমাতে, চুলকে সিল্কি করতে, চুলের অকালে পেকে যাওয়া রোধ করতে জবা বেশ ভালো কাজ করে। মেথি চুলের জন্য অত্যন্ত উপকারী। মেথির অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল উপাদানের জন্য এটি ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ রোধ করে। এছাড়া এটি প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে এবং চুল পড়াও বন্ধ করে। টক দই চুলের ময়েশ্চার ধরে রাখে, স্ক্যাল্পের ডেড সেলস দূর করে এবং চুলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে।
যা যা লাগবেঃ
- ১০-১২ টি জবা ফুলের পাতা
- ১ টেবিল চামচ মেথি
- ১/২ কাপ টক দই
যেভাবে বানাবেন ও এপ্লাই করবেন
- ১ টেবিল চামচ মেথি নিয়ে সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন।
- পরদিন সকালে ভেজানো মেথি এবং জবা পাতাগুলো একই সাথে ব্লেন্ড করে নিন।
- এই মিশ্রণের সাথে আধা কাপ টক দই মিশিয়ে নিন ভালো করে যেন একটি স্মুথ পেস্ট তৈরি হয়।
- চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত বিশেষ করে স্ক্যাল্পে প্যাকটি ভালো করে লাগিয়ে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন।
- একটি মাইল্ড সালফেট ফ্রি শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন।
দারুণ উপকারী এই পুষ্টিকর হেয়ার প্যাকটি সপ্তাহে একদিন ব্যবহারেই ড্যানড্রাফ তো দূর হবেই সাথে সাথে চুলের বৃদ্ধি ঘটবে। চুল হবে শাইনি ও হেলদি। তাই উজ্জ্বল, সুন্দর ও ঘন চুলের জন্য এই হেয়ার প্যাকটি ট্রাই করে দেখতেই পারেন।
৩। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুলের জন্য অরগানিকাওন এর হেয়ার ট্রিটমেন্ট প্যাক ও টি ট্রি অয়েলঃ
আমরা সাধারণত বেশ ব্যস্ত জীবন পার করি। এই ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে সব উপকরণ যোগাড় করে, সেগুলোকে রেডি করে হেয়ার প্যাক বানানোর সময় পাওয়াটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আবার অনেক সময় সব উপাদান পাওয়াও যায় না। এই সমস্যার চমৎকার একটি সমাধান হলো অরগানিকাওন ব্র্যান্ডের হেয়ার ট্রিটমেন্ট প্যাক এবং টি ট্রি অ্যাসেনসিয়াল অয়েল। এই হেয়ার প্যাকটি অ্যালোভেরা, মেহেদি, নিম, মেথি, শিকাকাই আমলকি এর মতো প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরী। এছাড়া টি ট্রি অয়েলে রয়েছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল উপাদান। যা চুলে ব্যাক্টেরিয়াল সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। এছাড়া স্ক্যাল্পে অয়েল প্রোডাকশনও ব্যালান্স করে টি ট্রি অয়েল। কোনো ঝামেলা ছাড়াই হেয়ারের জন্য তাই বানিয়ে নিতে পারেন দারুণ উপকারী এই প্যাক।
যা যা লাগবেঃ
- অরগানিকাওন হেয়ার ট্রিটমেন্ট প্যাক চুলের লেন্থ অনুযায়ী
- ২/৩ ফোঁটা টি ট্রি অয়েল
- প্রয়োজনমত পানি
যেভাবে বানাবেন ও অ্যাপ্লাই করবেনঃ
- একটি পরিষ্কার পাত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী হেয়ার প্যাক নিন। ২ থেকে ৩ ফোঁটা টি ট্রি অয়েল দিন।
- প্রয়োজন মত পানি দিয়ে একটি স্মুথ পেস্ট তৈরী করুন।
- পেস্টটি স্ক্যাল্প ও চুলে ভালো করে অ্যাপ্লাই করে ১৫ থেকে ২০ মিনিট অপেক্ষা করুন।
- শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে কন্ডিশনার অ্যাপ্লাই করুন।
সপ্তাহে মাত্র একদিনই ২০ মিনিটের জন্য এই হেয়ার প্যাকটি ব্যবহার করেই পেতে পারেন দারুণ হেলদি ও শাইনি হেয়ার। নিয়মিত ব্যবহার করতে শুরু করলেই চুলের অবস্থার উন্নতি বুঝতে পারবেন নিজেই।
৪। শুষ্ক চুলে প্রাণ ফেরাতে কলা, মধু, লেবু এবং অলিভ অয়েলের হেয়ার প্যাকঃ
কলা শুধু খেতেই যে সুস্বাদু আর শরীরের উপকার করে তা নয়, বরং চুলের যত্নেও কলা বেশ কার্যকরী। কলায় আছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, যা চুলকে ঘন ও শক্তিশালী করে তোলে। তাছাড়া কলা চুলকে ময়েশ্চারাইজ করে, ড্যানড্রাফ দূর করতে সাহায্য করে। চুলের ড্যামেজ রিপেয়ার করে চুলে শাইন আনে কলা। অলিভ অয়েল চুলকে সফট করে ও মজবুত করে তোলে। এছাড়া স্প্লিট এন্ড রিপেয়ার করতেও সাহায্য করে অলিভ অয়েল। লেবুর মাঝে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিড স্ক্যাল্পের পিএইচ লেভেল ঠিক করে ড্রাইনেস থেকে রক্ষা করে। মধু স্ক্যাল্পকে ময়েশ্চারাইজ করে, চুলকে মজবুত করে ও চুলের ফ্রিজিনেস দূর করে।
যা যা লাগবেঃ
- ২ টি পাকা কলা
- ১ টেবিল চামচ মধু
- ১ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল
- ১ টেবিল চামচ লেবুর রস
যেভাবে বানাবেন ও অ্যাপ্লাই করবেন
- কলা দুটি ভালোভবে ম্যাশ করে নিন যতক্ষন স্মুথ একটি পেস্ট তৈরী না হয়।
- কলার পেস্টে ১ টেবিলচামচ মধু, ১ টেবিল চামচ অলিভয়েল, ও ১ টেবিল চামচ লেবুর রস ভালো করে মিশিয়ে নিন।
- স্ক্যাল্পে ও চুলে এই নারিশিং ও রিপেয়ারিং মাস্কটি ভালোভাবে অ্যাপ্লাই করে ৩০ মিনিটের জন্য রেখে দিন।
- একটি মাইল্ড সালফেট ফ্রি শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন ও ন্যাচারালি শুকিয়ে নিন।
সপ্তাহে একদিন এই কার্যকরী হেয়ার প্যাক ইউজ করে আপনার রুক্ষ ও শুষ্ক চুলকে করে তুলুন প্রাণবন্ত।
৫। সফট ও হেলদি চুলের জন্য অ্যালোভেরা, ভিটামিন ই এবং অয়েলের হেয়ার প্যাকঃ
চুল নরম ও ময়েশ্চারাইজ করতে অ্যালোভেরার কোনো জুড়ি নেই। এতে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও মিনারেলস চুলের শুষ্কতা দূর করে, স্ক্যাল্প ঠান্ডা রাখে ও নারিশ করে। ভিটামিন ই স্ক্যাল্পের টক্সিক পার্টিকেলস দূর করে ও স্ক্যাল্প হেলদি রাখে। তাছাড়া এটি চুলের গ্রোথ বাড়ায়, অয়েল প্রোডিউস ব্যালান্স রাখে। যেকোনো অয়েল যেমন আমন্ড বা কোকোনাট বা অলিভ অয়েল চুলের জন্য অবশ্যই উপকারী। এগুলো চুলের স্ক্যাল্পকে ড্রাইনেস থেকে রক্ষা করে এবং চুলকে শাইনি করে।
যা যা লাগবেঃ
- ৩ চামচ অ্যালোভেরা জেল
- ২টি ভিটামিন ই ক্যাপসুল
- যেকোনো অয়েল কয়েক ফোঁটা (নারকেল/আমন্ড/অলিভ অয়েল)
বানাবেন এবং অ্যাপ্লাই করবেন যেভাবে
- দুটি ভিটামিন ই ক্যাপসুল নিয়ে এর ভেতরের তেলগুলো বের করে নিয়ে ৩ চামচ অ্যালোভেরা জেল ভালোভাবে মিক্স করে নিন।
- কয়েক ফোঁটা পছন্দ অনুযায়ী আমন্ড/নারকেল/অলিভ অয়েল ভালো করে মিক্স করে নিন।
- পুরো চুলে ভালোভাবে অ্যাপ্লাই করে ৪০-৪৫ মিনিট পরে শ্যাম্পু করে ফেলুন।
চুলকে ন্যাচারালি হেলদি, ময়েশ্চারাইজ ও নারিশ করতে এই মাস্কের কোনো জুড়ি নেই। সপ্তাহে মাত্র একদিন এই হেয়ার প্যাক ব্যবহার করে আপনার নষ্ট হয়ে যাওয়া চুলকে করতে পারেন রিপেয়ার।
এখানে বলা হেয়ার প্যাকগুলো সবই একদম ন্যাচারাল ও ঘরোয়া ইনগ্রেডিয়েন্টস দিয়ে তৈরী। তবুও অনেক সময় অনেককিছু আমাদের হেয়ারে বা স্কিনে স্যুট না-ও করতে পারে। সেক্ষেত্রে দেখা যায়
উপকারের বদলে আরো ক্ষতি হয়। তাই যেকোনো প্যাক ব্যবহারের আগে অবশ্যই তার সব উপাদান স্যুট করে কি না তা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
তো আজকে জানিয়ে দিলাম কীভাবে ড্যামেজড হেয়ারকে আবার আগের মত সফট, সিল্কি ও শাইনি করতে পারবেন। চুলের সমস্যা বুঝে আজই ট্রাই করে ফেলুন আপনার পছন্দের প্যাকটি। ব্যস্ত জীবনের রুটিনের ফাঁকে সপ্তাহে মাত্র একদিন অল্প কিছু সময় নিয়ে এই হেয়াপ্যাকগুলো ব্যবহার করে হেলদি, শাইনি ও গ্লোয়িং হেয়ার পেতে পারেন খুব সহজেই।
Leave a comment