ওজন যদি বেশি থাকে তাহলে ওবেসিটি বেড়ে যায়, সেই থেকে বাড়ে টাইপ টু ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, স্ট্রোক ও ক্যানসারের ঝুঁকি। শরীর থেকে বাড়তি ওজন ঝরিয়ে ফেললে এই সমস্যাগুলো অনেকটাই কমে আসে। মেয়েরা এই সমস্যায় বেশি ভোগে হরমোনাল ইমব্যালেন্স, মেটাবলিজম, এজিং থেকে শুরু করে শারীরিক নানা কারণে। এই সমস্যাগুলো সমাধানে ওজন কমানো বেশ জরুরি। ওয়েট লস জার্নি সবার জন্য সমান হবে এটা জরুরি নয়। ইন্টারনেট জুড়ে যখন মেয়েদের ওজন কমানোর টিপস দিয়ে ভর্তি, তখন কোন উপায়টি আসলে ইফেক্টিভ হবে সেটি খুঁজে পাওয়া কঠিন। আজ জানাবো কয়েকটি টিপসের ব্যাপারে যেগুলো মেয়েদের ওজন কমাতে সহায়ক হবে। সেই সাথে থাকবে ওজন বাড়ার কারণ, ওজন কমানোর সময় কোন কোন খাবার অ্যাভয়েড করবেন সেই তালিকা।
ওজন কেন বাড়ে?
নানা কারণে নারীদের ওজন বাড়তে পারে। এই কারণগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারলে ওজন কমানো সহজ হবে। যেমন-
হরমোনাল চেঞ্জ
বিভিন্ন কারণে হরমোনাল ফ্লাকচুয়েশন হতে পারে। যেমন- মেন্সট্রুয়েশন, প্রেগনেন্সি, মেনোপজ ইত্যাদি। এগুলো ওজন বাড়ার কিছু কারণ। আবার কেউ যদি পিসিওএস এ ভুগে থাকেন তাহলে সেই নারীদেরও ওজন বাড়বে।
পুষ্টিকর খাবার কম খাওয়া
হাই ক্যালরিযুক্ত খাবার খাওয়া, পুষ্টিকর খাবার কম খাওয়া, ফাস্ট ফুড, মিষ্টি জাতীয় খাবার, প্রসেসড আইটেম ওজন বাড়ায় দ্রুত।
এক্সারসাইজ না করা
নিয়মিত ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ কম করলে, ক্যালরি না পুড়লে ওয়েট বাড়তেই থাকবে।
স্ট্রেস থাকলে বেশি খাওয়া
ক্রনিক স্ট্রেস ও ইমোশনাল ফ্যাক্টরের কারণে ওভার ইটিং হয় এবং আনহেলদি ফুডের ক্রেভিং বাড়ে। যার কারণে বাড়তে থাকে ওজন।
ঘুম কম হওয়া
যদি পর্যাপ্ত ঘুম না হয়, সেক্ষেত্রে ক্ষুধা বাড়ানোর হরমোনগুলো আরও ক্ষুধা তৈরি করবে এবং ফলাফলস্বরূপ ওজন বাড়তে থাকবে।
মেডিকেশন
কিছু মেডিকেশন যেমন – অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টিসাইকোটিকস, কর্টিকসটেরয়েডস এর সাইড ইফেক্টের কারণে ওজন দ্রুত বাড়তে থাকে।
মেয়েদের ওজন কমানোর সহজ কয়েকটি উপায়
১) পর্যাপ্ত পানি পান করুন
ত্বক সুস্থ রাখার জন্য পানি পান করা যে জরুরি তা তো আমরা কমবেশি সবাই জানি। ওজন কমানোর জন্যও কিন্তু পানি পান জরুরি। বিশেষ করে খাবার খাওয়ার কিছুক্ষণ আগে। পানি দেড় থেকে দুই ঘন্টার জন্য ২৪-৩০% পর্যন্ত মেটাবলিজম বাড়ায় এবং ক্যালরি বার্ন হতে হেল্প করে।
আমেরিকার ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন থেকে প্রকাশিত বায়ো মেডিকেল ও লাইফ সায়েন্স সংক্রান্ত ফুল টেক্সট আর্কাইভ PubMed Central এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দিনে আধা ঘন্টার মাঝে অন্তত হাফ লিটার পানি পান করলে ৪৪ শতাংশ ওজন কমার সম্ভাবনা থাকে। আপনি যদি ওজন কমাতে চান, তাহলে ছোট্ট এই টিপসটি ফলো করে দেখতে পারেন।
২) ব্ল্যাক কফি পান করুন
দ্রুত ওজন কমানোর জন্য ব্ল্যাক কফি কার্যকরী বেশ কয়েকটি অ্যাকটিভ এজেন্টের মধ্যে একটি। এটা ৫০% পর্যন্ত মেটাবলিজম বাড়ায় এবং বেলি ফ্যাট কমায়। তাছাড়াও গ্লুকোজের বদলে প্রাইমারি এনার্জি সোর্স হিসেবে ফ্যাট সেলসকে ইউটিলাইজ করার জন্য ব্ল্যাক কফি নার্ভাস সিস্টেমকে স্টিমুলেট করে বডিকে সিগন্যাল দেয়। এতে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ওজন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
৩) ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করুন
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং হচ্ছে খাবার খাওয়া ও না খাওয়ার মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধান। এই ফাস্টিং এ আপনি কী খাচ্ছেন, কতটুকু খাচ্ছেন সেটা জরুরি নয়, বরং কোন সময়ে খাচ্ছেন বা খাচ্ছেন না সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জনপ্রিয় দুটো ইন্টারমিটেন্ট পদ্ধতি হলো ১৬ঃ৮ ও ৫ঃ২। ১৬ঃ৮ মানে হচ্ছে আপনার সুবিধা অনুযায়ী ৮ ঘন্টা খাবেন আর বাকি ১৬ ঘন্টা কোনো ধরনের ক্যালরি গ্রহণ করবেন না। এই সময়ের মধ্যে চাইলে অবশ্য ডিটক্স ওয়াটার, শসা বা কম ক্যালরির যে কোনো ফল খেতে পারেন। ৫ঃ২ হচ্ছে সপ্তাহে ৫ দিন স্বাভাবিক খাবার খাওয়া আর বাকি দুইদিন উপবাস থাকা। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন, যেটুকু ক্যালরি ইনটেক হচ্ছে সেটুকু যেন ওজন না বাড়ায়।
৪) সকালের নাস্তায় ডিম রাখুন
মেয়েরা ওজন কমানোর জন্য সকালের খাবার তালিকায় অবশ্যই ডিম রাখবেন। বৈজ্ঞানিক অনেক গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, শস্য জাতীয় খাবারের চেয়ে ডিমে ক্যালরি কম থাকে এবং ওজন ও বডি ফ্যাট কমাতে সাহায্য করে। যে সকল মেয়েরা ওজন কমাতে চান তারা সকালের নাস্তায় ডিম ও প্রোটিন জাতীয় খাবার রাখলে বেশি উপকার পাবেন।
৫) গ্রিন টি পান করুন
কফির মতোই গ্রিন টিও মেয়েদের ওজন কমাতে হেল্প করে। এতে ক্যাফেইন কম পরিমাণে আছে এবং ক্যাটেচিনস নামক পাওয়ারফুল অ্যান্টি অক্সিডেন্টে পূর্ণ। এই অ্যান্টি অক্সিডেন্টটি দ্রুত ওজন কমাতে সাহায্য করে। গ্রিন টি বেভারেজ হিসেবে এটি অনেকের কাছেই বেশ পছন্দের। ইফেক্টিভ ওয়েট লস টিপস হিসেবে মেয়েদের কাছে এটা বেশ আগে থেকেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে।
৬) রিফাইনড কার্বোহাইড্রেটকে না বলুন
রিফাইনড কার্বহাইড্রেটস ব্লাড সুগার লেভেল দ্রুত বাড়িয়ে দেয়, যার কারণে অল্প সময়েই ক্ষুধা লাগে, খাবারের ক্রেভিং হয়, বারবার খাবার খেতে হয়। সেই সাথে এর কারণে ওবেসিটির চান্সও বাড়ে। যে মেয়েরা ওজন কমাতে চান তারা তাদের ডায়েটে অবশ্যই কার্বোহাইড্রেট যোগ করতে পারেন, তবে সেই সাথে ন্যাচারাল ফাইবারও রাখতে হবে।
৭) লো কার্ব ডায়েটে ফোকাস করুন
এরপরের ওয়েট লস টিপস হচ্ছে লো কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার খাওয়া। যে মেয়েরা দ্রুত ওজন কমাতে চাচ্ছেন তাদের অবশ্যই এদিকে খেয়াল রাখতে হবে। লো ফ্যাট ডায়েটের চেয়ে লো কার্ব ডায়েট প্ল্যান ২/৩ গুণ ওজন কমাতে সাহায্য করে। সেইসাথে স্বাস্থ্যের উন্নতিও করে।
৮) বেশি ফাইবারযুক্ত খাবার খান
বেশি ফাইবারযুক্ত খাবার ওজন কমাতে বেশ সহায়ক। অ্যানালস অফ ইন্টারনাল মেডিসিন এর দেয়া তথ্যমতে, দিনে যদি ৩০ গ্রাম ফাইবার যুক্ত খাবার খাওয়া হয় তাহলে দ্রুত ওজন কমে। ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণ করতে, ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ফাইবারযুক্ত খাবার খুবই হেল্পফুল।
৯) পর্যাপ্ত ঘুমান
ওজন কমাতে ডায়েট ও এক্সারসাইজ যতই করা হোক না কেন, পর্যাপ্ত ঘুম যদি না হয়, সেক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ওজন পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। বেশ কয়েকটি গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, ঘুমের কমতি শরীরের ওজন বাড়ায় এবং ক্ষুধা লাগার জন্য যে ghrelin নামক যে হরমোনটি দায়ী, সেটির লেভেলও বাড়িয়ে দেয়। আর ক্ষুধা লাগলে খাবারও খাওয়া হয় বেশি। যার কারণে ওজনও বাড়তে থাকে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মেয়েদের অন্তত ৭ ঘন্টা পর্যাপ্ত ঘুমানো উচিত।
১০) নিয়মিত ব্যায়াম করুন
শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা জরুরি। ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটির পরিমাণ বাড়ালে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। দ্য আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এর মতে, সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট হাঁটলে ডেইলি অ্যাক্টিভিটির যে প্রয়োজনীয়তা সেটা পূরণ হয়। যারা শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করা থেকে দূরে থাকেন বা আগ্রহ পান না, তাদের ধীরে ধীরে ওজন বাড়তে থাকে যা এক সময় শরীর খারাপ করেই দেয়। লাইফস্টাইলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটিকে ইনক্লুড করা জরুরি নিজের সুস্থতার জন্যই।
মেয়েরা কীভাবে ওজন কমাতে পারেন তা নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকে। অনেকেই ডায়েট প্ল্যান তৈরি করেন খুব হার্শভাবে। অনেকে আবার সারাদিন না খেয়ে থাকেন। সঠিকভাবে ডায়েট চার্ট না মেনে বা সারাদিন না খেয়ে ওজন হয়ত কমবে, কিন্তু কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে যাবেন। তাই এমন প্ল্যান করুন যেখানে সঠিক ডায়েটও থাকবে, আবার ওজনও কমবে। আজ যে উপায়গুলো শেয়ার করলাম সেগুলো যদি নিয়মিত ফলো করেন, তাহলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা একদমই কঠিন মনে হবে না।
Leave a comment