শীতে ময়েশ্চারাইজড থাকতে স্কিনকেয়ারে যোগ করবেন যে ৫ টি উপাদান

চলে এসেছে শীত, প্রকৃতিতে হিম হিম ঘ্রাণ। সাথে শুরু হয়েছে শুষ্কতা রুক্ষতা। হাত পা হয়ে যাচ্ছে খসখসে, মুখের চামড়ায় ধরছে টান। হচ্ছে র‍্যাশ, স্কিন ইরিটেশন। বাড়ছে ডেড সেলস অথবা ফ্লেকিনেস। এ সময় স্কিন, হেয়ার সবকিছুরই প্রয়োজন হয় একটু বিশেষ যত্নের। তাই রেগুলার স্কিনকেয়ারের পাশাপাশি বাড়তি কিছু জিনিস যোগ করার প্রয়োজন হয়। আজকে আমরা এই বিষয়ের আদ্যোপান্ত জানবো।

 

হায়ালুরোনিক অ্যাসিড

ময়েশ্চারাইজড থাকতে একটি অসাধারণ উপাদান হলো হায়ালুরোনিক অ্যাসিড। শুধু শীতেই নয় বরং সারাবছরই ময়েশ্চারাইজড থাকতে এর বিকল্প কমই আছে। এটি মূলত একটি সুগার মলিকিউল যা আমাদের চোখ, স্কিন এবং দেহের জয়েন্টগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে হয়ে থাকে। এটি ন্যাচারাল লুব্রিক্যান্ট হিসেবে কাজ করে। তবে বর্তমানে হায়ালুরনিক অ্যাসিড কৃত্রিমভাবেও তৈরী করা যায় আবার প্রাকৃতিক বিভিন্ন উৎস থেকেও সংগ্রহ করা যায়। হায়ালুরনিক অ্যাসিডের সবচেয়ে দারুণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি স্পঞ্জের মতো কাজ করে এবং নিজের ওজনের চেয়েও ১০০০ গুন বেশি পানি ধরে রাখতে পারে। তাই শীতের এই শুষ্ক আবহাওয়ায় ময়েশ্চারাইজড থাকতে হায়ালুরনিক অ্যাসিডের বিকল্প খুঁজে পাওয়া কঠিনই। এই উপাদানের বেনিফিটস- 

 

  • ত্বকে পানি ধরে রেখে ড্রাই হওয়া থেকে রক্ষা করে ও হাইড্রেটেড রাখে।
  • ত্বকের ব্যারিয়ার মজবুত করে ময়েশ্চারাইজড রাখে।
  • এর মাঝে থাকা অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি উপাদানের জন্য একনে, র‍্যাশ, ইরিটেশন ইত্যাদি দূর করে।
  • কোলাজেন প্রোডাকশন বাড়িয়ে দেয় ফলে রিংকেলস, ফাইন লাইনস এগুলো হতে পারে না। 
  • সানট্যান, পিগমেন্টেশন ইত্যাদি দূর করে ত্বক ভেতর থেকে রিপেয়ার করে।
  • ওপেন পোরস টাইট করে।

 

এছাড়াও হায়ালুরোনিক অ্যাসিডের আরো অনেক গুনাগুন আছে যা বলে শেষ করা যাবে না। তাই এই শীতে স্কিনে ড্রাইনেস এর থাবা থেকে বাঁচতে স্কিনকেয়ারে প্রোডাক্টস এ যোগ করতে হবে এমন প্রোডাক্ট যেটাতে হায়ালুরোনিক অ্যাসিড আছে। বর্তমানে বিভিন্ন স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টস যেমন- সিরাম, ময়েশ্চারাইজার, নাইট ক্রিম, ফেইসওয়াসেও হায়ালুরোনিক অ্যাসিড থাকে। তাই শীতে স্কিনকেয়ারে যোগ করে নিন এমন প্রোডাক্টস যা হায়ালুরোনিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ।

 

গ্লিসারিন

শীতের যত্নে গ্লিসারিনের চল আমাদের দেশে বেশ আগে থেকেই আছে। ছোট্ট কাঁচের বোতলে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার গ্লিসারিন ব্যবহার করতে আমাদের মা চাচীদের আমরা দেখেছি ছোটবেলায়। যে সময় এত বেশি প্রসাধনীর বাহার ছিল না, মানুষ ত্বক নিয়ে এত সচেতনও ছিলো না সে সময় থেকেই গ্লিসারিন ছিলো ত্বকের যত্নের একটি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। সারাবছর ব্যবহার করা গেলেও শীতকালে এর ব্যবহার হতো বেশি। এখন নানারকম প্রসাধনীর ভিড়ে আমরা অনেক সময়ই গ্লিসারিনের কথা ভুলে যাই তবে এটি আসলেই অত্যন্ত উপকারী জিনিস। সাধারণত উদ্ভিদ ও প্রাণীজ উৎস থেকে পাওয়া গ্লিসারিন বর্ণ ও গন্ধহীন। সাধারণত খাঁটি গ্লিসারিন বানাতে কোনোরকম কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না তাই এটি ত্বকের যত্নে অত্যন্ত ভালো। গ্লিসারিনের মধ্যে থাকা ট্রাই হাইড্রক্সি অ্যালকোহল ত্বকের আর্দ্রতা দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও গ্লিসারিন ব্যবহারের নানারকম উপকার আছে।

 

  • গ্লিসারিন হিউমিকট্যান্ট হিসেবে কাজ করে অর্থ্যাৎ এটি ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে। ফলে স্কিন হয় আরো সফট ও প্লাম্পি। স্কিন রক্ষা পায় ড্রাইনেস থেকে। 
  • গ্লিসারিন স্কিনের ব্যারিয়ার ইম্প্রুভ করে ফলে বাইরের ক্ষতিকর পার্টিকেলস বা আবহাওয়া স্কিনের ক্ষতি করতে পারে না।
  • ক্ষত সারাতেও গ্লিসারিন বেশ সাহায্য করে। এটি ব্যারিয়ারকে মজবুত করে ময়েশ্চারাইজ ধরে রাখে। এর অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল উপাদান ব্যাক্টেরিয়াল আক্রমণ থেকে স্কিন রক্ষা করে।
  • গ্লিসারিন অ্যান্টি এজিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে। এটি স্কিনকে স্মুথ করে, ড্রাইনেস থেকে বাঁচায় ফলে রিংকেলস ও ফাইন লাইনস হতে পারে না।
  • গ্লিসারিন স্কিনের ইলাস্টিসিটি বাড়ায়।
  • এটি পোরস ক্লিন করে ফলে একনে হয় না, কোনো ময়লাও জমতে পারে না এবং স্কিন থাকে হেলদি। 
  • এটি ড্রাই স্কিনের জন্য খুবই উপকারী যেহেতু এটি দীর্ঘ সময় ময়েশ্চার ধরে রাখে।
  • একজিমা ও সোরাইসিসের মতো স্কিন কন্ডিশনের ক্ষেত্রেও গ্লিসারিন প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবে কাজ করে। 

 

সাধারণত ব্যবহারযোগ্য গ্লিসারিন সরাসরি পাওয়া যায়। এছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন ময়েশ্চারাইজার, লোশন, ক্রিম এসবের মাঝেও গ্লিসারিন থাকে। তাই শীতের রুক্ষ কঠিন আবহাওয়ায় স্কিনকে নরম ও প্লাম্পি রাখতে বেছে নিন গ্লিসারিন অথবা গ্লিসারিনযুক্ত স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট।

 

ভিটামিন সি

শীতকালে স্কিন ড্রাই হওয়ার পাশাপাশি আরো একটি বড় সমস্যা দেখা দেয় যেটা তা হলো কালো হয়ে যাওয়া, পিগমেন্টেশন বেড়ে যাওয়া। ভিটামিন সি মেলানিন উৎপাদন কমিয়ে দেয়, যার জন্য মূলত ত্বক বেশি কালো দেখায়। এছাড়া এটি স্কিন হাইড্রেট রাখে ফলে ড্রাইনেস, ফ্লেকিনেস এসব থেকে রক্ষা পায়। ভিটামিন সি ত্বকের জন্য যা করেঃ

 

  • ভিটামিন সি ত্বকের জন্য সবচেয়ে বড় যে কাজটি করে তা হলো কোলাজেন গ্রোথ বুস্ট আপ করে। কোলাজেন স্কিন হাইড্রেট রাখে, ইলাস্টিসিটি বাড়ায় ও রিংকেলস দূর করে। ফলে অকালে বুড়িয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ভিটামিন সি এটির উৎপাদন বৃদ্ধি করে থাকে।
  • ভিটামিন সি, হায়লুরোনিক অ্যাসিড উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে ফলে স্কিন হাইড্রেট থাকে।  
  • এটি সানট্যান, সানবার্ন এসব থেকে স্কিন প্রোটেক্ট করে ও স্কিনের বাইরের ব্যারিয়ারকে পল্যুশন ও ক্ষতিকারক জিনিস থেকে রক্ষা করে।

 

তাই এই শীতে কমে যাওয়া ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে অবশ্যই স্কিনকেয়ার রুটিনে যোগ করে নিন এমন প্রোডাক্ট যাতে আছে ভিটামিন সি। 

 

রেটিনল

রেটিনল হলো ভিটামিন বি১ এর একটি ফর্ম, যা বর্তমানে বিউটি প্রোডাক্টসে বহুল ব্যবহৃত একটি জিনিস। ভিটামিন এ আমাদের শরীর ও ত্বকের জন্য অনেক বেশি উপকারী। খাবারের পাশাপাশি স্কিনের জন্যও বর্তমানে নানাভাবে ভিটামিন বি অ্যাপ্লাই করা হয়ে থাকে। রেটিনলের সবচেয়ে বড় কাজ হলো ডেড স্কিন সেলস রিমুভ করা যেটি শীতকালে স্কিনের সবচেয়ে বড় একটি সমস্যা। শীতকালে আমাদের স্কিনে ড্রাইনেসের কারণে প্রচুর ডেড সেলস হয়, স্কিন ফ্লেকি হয়ে থাকে। ভিটামিন বি এগুলো দূর করে থাকে। ভিটামিন বি বা রেটিনল স্কিনের যেসব উপকার করে থাকেঃ

 

  • সাধারণত বাজারের কেমিক্যালযুক্ত এক্সফোলিয়েন্টগুলো ডেড সেলস ডিজলভ করে দূর করে থাকে। রেটিনল এক্ষেত্রে আলাদা। এটি নতুন সেলস গঠন দ্রুত করে ফলে ডেড সেলস ক্লিন হয়ে যায়।
  • রেটিনলের মাঝে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট প্রোপার্টিজ কোলাজেন ড্যামেজ প্রিভেন্ট করে এবং এর প্রোডাকশন বুস্ট আপ করে।
  • আনইভেন স্কিনটোন, হাইপারপিগমেন্টেশন, সানবার্ন, সানট্যান ইত্যাদি দূর করে স্কিনকে করে ব্রাইট ও গ্লোয়ি।
  • পল্যুশন ও এনভায়রনমেন্টাল ড্যামেজ, ফ্রি রেডিক্যালস ইত্যাদি থেকে স্কিনকে রক্ষা করে হেলদি ও স্ট্রং করে।
  • রেটিনল ক্লগ পোরস ক্লিন করে এবং এতে অতিরিক্ত তেল, ধুলা ময়লা ইত্যাদি জমতে দেয় না। তাই একনে হওয়া থেকে পাবেন মুক্তি।
  • রেটিনল কোলাজেন ও ইলাস্টিন এই দুটির গ্রোথ বুস্ট আপ করে যার ফলে স্কিনে রিংকেলস, ফাইন লাইনস এগুলো তৈরি হতে পারে না। 

 

তো বুঝতেই পারছেন রেটিনল একটি হেলদি ইয়াংগার লুকিং স্কিনের জন্য কতটা কার্যকরী। বর্তমানে রেটিনল সিরাম আকারেই পাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন ক্রিম, জেল অথবা লোশনেও রেটিনল থাকে। তাই শীতেও ত্বক উজ্জ্বল ও তারুণ্যোদীপ্ত রাখতে দেরি না করে স্কিনকেয়ার রুটিনে রেটিনলযুক্ত প্রোডাক্ট যোগ করুন আজই।

সিয়া বাটার, কোকোয়া বাটার

সিয়া বাটার আফ্রিকার সিয়া গাছের বাদাম থেকে এক্সট্রাক্ট করা হয়ে থাকে। এটি ন্যাচারাল ময়েশ্চারাইজার হিসেবে বর্তমানে নানারকম প্রোডাক্টে ব্যবহার হয়ে থাকে। কোকোয়া বিন থেকে এক্সট্রাক্ট করা কোকোয়া বাটার অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে দারুণ কাজ করে। তাই শীতকালীন স্কিন প্রবলেমগুলোর জন্য দারুণ দুটি উপাদান হল সিয়া বাটার ও কোকোয়া বাটার। স্কিনকেয়ারের ক্ষেত্রে এই দুটি উপাদানের নানা উপকারিতা রয়েছে। যেমনঃ

  • কোকোয়া বাটার ন্যাচারাল ইমোলিয়েন্ট যা স্কিনকে রাখে ময়েশ্চারাইজড, ফলে স্কিন থাকে নরম ও কোমল। সিয়া বাটারও স্কিনকে ডিপলি ময়েশ্চারাইজ করে এবং ময়েশ্চার লক করে।
  • সিয়া ও কোকোয়া বাটার স্ট্রেচ মার্কস দূর করে।
  • এগুলো স্কিনের ব্যারিয়ারকে প্রোটেক্ট করে, ফ্রি রেডিক্যালস থেকে রক্ষা করে, ফলে স্কিন থাকে হেলদি।
  • সিয়া বাটারে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান স্কিন ইরিটেশন কমায়, প্রিম্যাচিউর এজিং থেকে রক্ষা করে।
  • কোকোয়া বাটার স্কিনের ইলাস্টিসিটি বাড়ায়, ড্যামেজ স্কিন রিপেয়ার করে স্কিন গ্রোথ বাড়ায়। 

 

সিয়া ও কোকোয়া বাটার বর্তমানে নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন চেনাজানা ব্র্যান্ড থেকে অর্গানিক ব্র্যান্ড সকলেই বডি লোশন, ক্রিম, লিপ বাম, বডি ও লিপ স্ক্রাব, শাওয়ার জেল ইত্যাদি নানা স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টে এই দুটি বাটার ব্যবহার করে থাকে। তাই শীতকালে দারুণ হেলদি আর স্ক্র্যাচ ফ্রি ইয়াং স্কিন পেতে আপনার স্কিনকেয়ার রুটিনে সিয়া বাটার বা কোকোয়া বাটার আছে এমন প্রোডাক্ট যোগ করে ফেলুন।  

বর্তমানে বাজারে নানারকম স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টের ছড়াছড়ি। তাই আমরা সহজেই কনফিউজড হয়ে যাই কোনটি আসলেই ভালো হবে আমাদের জন্য। শীতকালে সবরকম স্কিনই একটু সেনসিটিভ হয়ে যায় তাই বাড়তি যত্নেরও প্রয়োজন হয়। এজন্য একটু খেয়াল করে এই ড্রাই ওয়েদারে বেনিফিট হবে এমন উপাদান যুক্ত প্রোডাক্ট কেনাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া যত বেশি কেমিক্যাল ফ্রি প্রোডাক্ট ব্যবহার করা যায় ততই স্কিনের জন্য ভালো। এক্ষেত্রে দেশীয় ব্র্যান্ড অর্গানিকাওন এর প্রোডাক্টগুলো নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারেন কারণ এখানে কোনো কৃত্রিম কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। তাই হেলদি, গ্লোয়িং স্কিনের জন্য অর্গানিকাওন হতে পারে সেরা বন্ধু।