যারা স্কিনের একটু খেয়াল রাখেন বা নিয়মিত স্কিনকেয়ার করেন তাদের কাছে অ্যাপেল সিডার ভিনেগার বা ACV একটি পরিচিত নাম। শুধু স্কিনকেয়ারেই নয় বরং স্বাস্থ্যের নানাবিধ উপকারে এটি বেশ কার্যকরী এক উপাদান। আজকে আমরা এই দারুণ জিনিসটি নিয়ে জানবো।
অ্যাপেল সিডার ভিনেগার কী?
আপেল সিডার ভিনেগার মূলত ফরমেন্টেড আপেল থেকে তৈরী করা হয় যা ভিনেগার হিসেবে কাজ করে। এটি দুইটি ধাপে তৈরী করা হয়ে থাকে। প্রথম ধাপে আপেল থেকে জুস করা হয় এবং তার সাথে ইস্ট মিশিয়ে আপেল জুসের মাঝে থাকা সুগারকে ইথানল বানানো হয়। পরবর্তী ধাপে এই ইথানলকে অ্যাসিটিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত করা হয়। অ্যাসিটিক অ্যাসিড এবং ম্যালিক অ্যাসিড মিলে ভিনেগারের টক স্বাদ তৈরী করে।
অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহারের উপকারিতা
অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহারের উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। স্বাস্থ্যের উপকারের পাশাপাশি, ত্বক এবং চুলের জন্যও দারুণ কার্যকরী একটি জিনিস এই অ্যাপেল সিডার ভিনেগার। চলুন আজকে এর কিছু গুনাগুন জেনে নিই।
ত্বকের যত্নে অ্যাপেল সিডার ভিনেগারঃ
১। ব্রণ দূর করতেঃ
ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ ব্রণের অন্যতম একটি কারণ। ব্যাক্টেরিয়া এবং ত্বকে জমে থাকা অয়েল ও ময়লা পোরস ক্লগ করে দিয়ে ব্রণের সৃষ্টি করে থাকে। অ্যাপেল সিডার ভিনেগারে থাকা বিভিন্ন জৈব এসিড এসকল ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে। বিশেষত এর মাঝে থাকা অ্যাসিটিক অ্যাসিড ব্যাক্টেরিয়ার বৃদ্ধিতে বাঁধা দেয় ও ব্যাক্টেরিয়াল বায়োফিল্মগুলোকে নষ্ট করে দেয়। ফলে ব্যাক্টেরিয়ার বার বার সংক্রমণ হওয়ার সুযোগ থাকে না আর। তাই ব্রণের চিকিৎসায় অ্যাপেল সিডার ভিনেগার একটি শক্তিশালী উপাদান। তাই নিয়মিত স্কিনকেয়ার রুটিনে যোগ করলে ব্রণের ব্রেক আউট থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
২। ত্বকের পিএইচ লেভেল ব্যালান্স করতেঃ
পিএইচ লেভেল ত্বকের পুরো ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি আপনার ত্বকের বাইরের ব্যারিয়ারকে সব পল্যুশন, ব্যাক্টেরিয়া, ময়লা ও বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। এছাড়া ত্বকের প্রয়োজনীয় অয়েল প্রোডিউস করতে সাহায্য করে। কাজেই পিএইচ লেভেল ব্যালান্স রাখা অত্যন্ত জরুরি। অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ত্বকের এই পিএইচ লেভেল ব্যালান্স করতে সাহায্য করে। ফলে আপনার ত্বক থাকে হেলদি এবং গ্লোয়িং সবসময়।
৩। এক্সফোলিয়েটর হিসেবেঃ
সাধারণত ৩০ দিন পর পর আমাদের পুরোনো স্কিন সেলস ঝরে গিয়ে নতুন স্কিন সেলস তৈরী হয়। এটি একটি ন্যাচারাল প্রক্রিয়া। কিন্তু আমরা যদি ঠিকমতো এই ডেড স্কিন সেলসগুলোকে পরিষ্কার না করি তাহলে অনেক সময় সেটি পোরস ক্লগ করে দিতে পারে, স্কিন ফ্লেকি করে দিতে পারে। এছাড়া একটি অস্বস্তিকর অনুভূতির সাথে সাথে স্কিনের গ্লোও কমে যেতে পারে, হতে পারে র্যাশ। তাই এক্সফোলিয়েটিং করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এক্ষেত্রে অ্যাপেল সিডার ভিনেগার দারুণ কাজ করে। এটি খুবই সফট এবং জেন্টল এক্সফোলিয়েটর হিসেবে কাজ করে। অ্যাপেল সিডার ভিনেগারে থাকে ফল থেকে উৎপাদিত ম্যালিক অ্যাসিড যেটি মূলত এই এক্সফোলিয়েটর হিসেবে কাজ করে থাকে।
৪। অ্যান্টি এজিং এজেন্ট হিসেবেঃ
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের স্কিনে রিংকেলস, ফাইন লাইনস ইত্যাদি দেখা দিতে শুরু করে। অ্যাপেল সিডার ভিনেগার এই রিংকেলস, স্কিনের বিভিন্ন দাগ দূর করে থাকে। মূলত এর মাঝে থাকা বিভিন্ন ভিটামিন এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ত্বকের কোষ টান টান রাখে, কোষগুলোকে মজবুত করে এবং রিংকেলস হওয়া থেকে রক্ষা করে। এছাড়া এটি কোলাজেন উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। তাই অ্যান্টি এজিং এজেন্ট হিসেবে অ্যাপেল সিডার ভিনেগার একটি দারুণ উপাদান।
৫। আফটারশেভ হিসেবেঃ
শুধু মেয়েদেরই স্কিনকেয়ারে কাজে লাগবে অ্যাপেল সিডার ভিনেগার এমন নয়, বরং ছেলেরাও এটিকে নানা কাজে ব্যবহার করতে পারেন। এর মাঝে একটি দারুণ ব্যবহার হলো আফটারশেভ হিসেবে ব্যবহার করা। এটির অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল উপাদান আপনার ত্বককে রাখবে সুরক্ষিত। তাছাড়া ছোটখাটো কাটাছেঁড়া ইত্যাদি সারাতেও অ্যাপেল সিডার ভিনেগারের জুড়ি নেই। তাই আফটারশেভ হিসেবে একটি দারুণ জিনিস হলো অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার।
৬। স্কিনের গ্লো বাড়ানোঃ
অ্যাপেল সিডার ভিনেগার সানট্যান ও সানবার্ন রিমুভ করে, রিংকেলস ও ফাইন লাইনস দূর করে। আনইভেন স্কিন টোন ব্যালান্স করতেও হেল্প করে। তাই ঠিকমতো অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করলে স্কিনের গ্লো ফিরে আসতে থাকে।
কীভাবে ব্যবহার করবেন
অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার অনেক উপকার করলেও ত্বকের যত্নে এটিকে সরাসরি ব্যবহার করা যায় না। যেহেতু এতে রয়েছে বেশ কিছু অ্যাসিড এবং এটি একটি অ্যাক্টিভ উপাদান, তাই সরাসরি ত্বকে ব্যবহার করলে এটি উপকারের বদলে ক্ষতি বেশি করতে পারে। তাহলে কীভাবে ব্যবহার করবেন? নিচে কিছু পদ্ধতি দেয়া হলোঃ
১। অ্যাপেল সিডার ভিনেগার টোনারঃ
যা যা লাগবেঃ
১। ১ চা চামচ অ্যাপেল সিডার ভিনেগার
২। কয়েক ফোঁটা অ্যাসেনসিয়াল অয়েল
৩। ৪ চা চামচ পানি
কীভাবে বানাবেনঃ
একটি পরিষ্কার বাটিতে ১ চা চামচ ভিনেগার ও ৪ চা চামচ পানি নিন। এর মাঝে কয়েক ফোঁটা অ্যাসেনসিয়াল অয়েল দিয়ে ভালোভাবে মিক্স করে দিন। মিশ্রণটি স্প্রে বোতলে বা নরমাল কোন বোতলে নিয়ে ফ্রিজে সংরক্ষণ করুন।
এই টোনার বানানোর জন্য অরগানিকাওন অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ও অ্যাসেনসিয়াল অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। অরগানিকাওন সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে তাদের প্রোডাক্ট তৈরী করে থাকে তাই কেমিক্যালের কারণে ত্বকের ক্ষতি হওয়ার ভয় নেই।
টোনার অ্যাপ্লাই করার নিয়মঃ
টোনার বানানো তো হলো এবার স্কিনে অ্যাপ্লাই করবেন কীভাবে? খুবই সহজ পদ্ধতিতে এটি ব্যবহার করতে পারেন। প্রথমে একটি তুলার প্যাড বা বল নিন। এটিতে অল্প করে টোনার স্প্রে করুন অথবা ফোঁটায় ফোঁটায় দিন। চোখের অংশ বাদে পুরো মুখে লাগিয়ে নিন। সবচেয়ে ভালো ফলাফলের জন্য এটিকে মুখেই শুকাতে দিন, ধুয়ে ফেলবেন না। মুখ ধোয়ার পর এটি ব্যবহার করলে তাই ভালো হয়। সপ্তাহে একদিন এই টোনারটি ইউজ করলে বেনিফিটসগুলো নিজেই খেয়াল করতে পারবেন।
ফেইসপ্যাক হিসেবেঃ
অ্যাপেল সিডার ভিনেগার দিয়ে ফেইসপ্যাক বানিয়েও ব্যবহার করতে পারেন। আপনার নিয়মিত ব্যবহার করা ফেইসপ্যাকের সাথে ১ চা চামচ ভিনেগার মিশিয়ে নিয়ে ব্যবহার করুন। সপ্তাহে একদিন ফেইসপ্যাকের সাথে ব্যবহার করলেই উপকারিতা পেতে থাকবেন।
অরগানিকাওন এ Apple Cider Vinegar এর সাথে পাবেন ব্রাইটেনিং প্যাক, একনে ট্রিটমেন্ট প্যাক। এই প্যাকগুলোতে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ঘরে বসে প্রাকৃতিক উপাদানের সাথে ত্বকের যত্ন নিতে চাইলে আজই ট্রাই করতে পারেন অরগানিকাওন এর ফেইস প্যাকগুলো।
আফটারশেভ হিসেবেঃ
আফটারশেভ হিসেবে ব্যবহার করতে ১ঃ১ অনুপাতে পানি ও ভিনেগার নিন। চাইলে অ্যাসেনসিয়াল অয়েল দিতে পারেন কয়েক ফোঁটা। এরপর এটিকে ভালো করে ঝাঁকিয়ে মিশিয়ে নিন এবং একটি স্প্রে বোতলে সংরক্ষণ করুন। প্রতিদিন অন্তত একবার মিশ্রণটি ঝাঁকিয়ে রাখবেন। এছাড়া প্রতিবার ব্যবহারের আগে অবশ্যই ঝাঁকিয়ে নিবেন।
চুলের যত্নে অ্যাপেল সিডার ভিনেগারঃ
চুলের যত্নেও এটির ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়। বায়োটিন, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন বি এর মত চুলের জন্য উপকারী নানা রকম উপাদানে ভরপুর এই অ্যাপেল সিডার ভিনেগার। চলুন জেনে নিই চুলের জন্য কী কী সাহায্য করে থাকে এই ম্যাজিক্যাল জিনিসটি।
১। হেলদি স্ক্যাল্প বজায় রাখতেঃ
এটি স্ক্যাল্প হেলদি রাখতে এবং স্ক্যাল্পের পি এইচ লেভেল ঠিক রাখতে সাহায্য করে। এর অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল উপাদানের জন্য স্ক্যাল্পে ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ সহজে হয় না। ফলে স্ক্যাল্প থাকে হেলদি।
২। ড্যানড্রাফ দূর করতেঃ
আপেল সিডার ভিনেগার ন্যাচারাল এক্সফোলিয়েন্ট হিসেবে কাজ করে। তাই ড্যানড্রাফের বিরুদ্ধে এটি বেশ শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। এছাড়া ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ থেকেও রক্ষা করে তাই ড্যানড্রাফ হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।
৩। চুল মজবুত করতেঃ
এই ভিনেগার কিউটিকলকে আলগা হওয়া থেকে প্রতিরোধ করে। ফলে চুল পড়া বন্ধ হয়। চুল হয় শক্তিশালী। চুল পড়া কমাতে হেয়ার কেয়ার রুটিনে এটি হতে পারে মাস্ট হ্যাভ একটি প্রোডাক্ট।
৪। চুলের ফ্রিজিনেস ও কোঁকড়া ভাব দূর করতেঃ
আমাদের অনেকেরই চুলে উষ্কখুষ্ক ভাব আছে, কারো বা সোজা চুল আস্তে আস্তে কোঁকড়া হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহারে এই সমস্যাগুলো আস্তে আস্তে চলে গিয়েছে। তাছাড়া এটি চুলকে বেশ স্মুথও করে থাকে। তাই চুলের ফ্রিজিনেস ও কোঁকড়া ভাব দূর করতে নিয়মিত এটি ইউজ করতে পারেন।
চুলে কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ
অ্যাপেল সিডার ভিনেগার চুলে ব্যবহার করার জন্য পানির সাথে ডায়ালুট করে নিতে হবে ১ঃ১ অনুপাতে। এরপর এই মিশ্রণটি একটি স্প্রে বোতলে ভরে ফেলতে হবে। চুলে শ্যাম্পু করে কন্ডিশনার লাগিয়ে চুল শুকিয়ে নিতে হবে। এরপর চুলগুলোকে কয়েকটি সেকশন করে স্ক্যাল্পে এই অ্যাপেল সিডার ভিনেগারের মিশ্রণটি স্প্রে করে ৫ থেকে ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এরপর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। কোনোভাবেই এই মিশ্রণটি ১৫ মিনিটের উপর মাথায় রাখবেন না।
সতর্কতাঃ
অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার একটি অ্যাক্টিভ উপাদান। তাছাড়া এটি অ্যাসিডিকও বটে। তাই সরাসরি এটিকে হেয়ার বা স্কিনে অ্যাপ্লাই করা থেকে বিরত থাকুন। অনেকের হেয়ার বা স্কিনে এটি স্যুট নাও করতে পারে, সেক্ষেত্রে র্যাশ, এলার্জি অথবা ইরিটেশন দেখা দিতে পারে। তাই ব্যবহারের আগে অবশ্যই টেস্ট করে নিতে হবে এটি স্যুট করছে কি না।
অ্যাপেল সিডার ভিনেগার স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। এর মাঝে থাকা অ্যাসিটিক অ্যাসিড, এনজাইম, প্রোটিন ইত্যাদি শরীরের নানাবিধ উপকার করে। এছাড়া এটি নিয়মিত খেলে ওজন কমাতে সাহায্য করে। এটি ব্লাডের সুগার লেভেল ব্যালান্স করে ফলে ডায়াবেটিস রোগীরাও এর থেকে সুফল পায়। এটি শরীরের ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া মেরে ফেলে এবং অ্যাসিডিটি থেকেও মুক্তি দেয়। তাই সঠিক নিয়মে অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করলে হেলথ, হেয়ার এবং স্কিনের অনেক সমস্যাই দূর করতে পারবেন।
Leave a comment