ধরুন আপনি বাইরে যাচ্ছেন, ঘরের দরজায় তালা লাগালেন। লাগানোর পর আবার একটু টেনে দেখলেন এটি ঠিকমতো লেগেছে কিনা। এটি ডাবল চেক, আমরা ভালোভাবে শিওর হওয়ার জন্য করে থাকি। এই বাড়তি সতর্কতা আমাদেরকে অনেক বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দেয়। ঠিক তেমনই ডাবল ক্লিনজিং হলো দুইবার ত্বক পরিষ্কার করা। অনেক সময় একবার ক্লিন করার পরও স্কিন ঠিকমতো ক্লিন না-ও হতে পারে। তাই ডাবল ক্লিনজিং করলে ত্বকে ময়লা জমে থাকার আর কোনো চান্স থাকে না। ত্বক ভেতর থেকে পরিষ্কার হয়, কমে যায় ব্রণ ও অন্যান্য স্কিন প্রবলেম হওয়ার চান্স। অনেকেই জানেন না ডাবল ক্লিনজিং কী বা কীভাবে করতে হয়। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক এ বিষয়ে বিস্তারিত।
ডাবল ক্লিনজিং কী?
ডাবল ক্লিনজিং যদিও এই যুগে এসে আমাদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তবে এর শুরু কিন্তু প্রাচীনকাল থেকেই। জাপান ও কোরিয়ায় ১৪শ’ শতকের দিকে নারীদের মাঝে মুখে সাদা ঘন পেইন্ট লাগিয়ে এর উপর লাল ও কালো পেইন্ট দিয়ে সাজার চল ছিলো। এগুলো ঘন হওয়ার কারণে মুখ পরিষ্কার করতে গেলে একবারে হতো না। সে সময় তারা ফেইস অয়েল দিয়ে এগুলো পরিষ্কার করতো এরপর সোপ দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলতো। তখন থেকেই এই ডাবল ক্লিনজিং এর উৎপত্তি। এরপর জাপান ও কোরিয়া থেকেই সারা বিশ্বে ডাবল ক্লিনজিং মেথড ছড়িয়ে পড়েছে।
অনেকেই মনে করেন ডাবল ক্লিনজিং হলো দুইবার মুখ ধোয়া। কথাটা পুরোপু্রি সঠিক নয়, আবার একদম ভুলও নয়। ডাবল ক্লিনজিং হলো সেই মেথড, যেখানে প্রথমে একটি ক্লিনজিং অয়েল, ক্লিনজিং বাম বা মাইসেলার ওয়াটার কটনপ্যাডে নিয়ে মেকআপ পার্টিকেলস, ডার্ট, পল্যুশন, সানস্ক্রিন ক্লিন করে নেয়া হয়। এরপর ফেইসওয়াশ বা সোপ দিয়ে আবারও ফেইস ক্লিন করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়। এ পদ্ধতিতে ফেইস ক্লিন করলে ফেইসে কোনোরকম ময়লা, ধুলো, মেকআপ রেসিডিউ জমে থাকার চান্স থাকে না। ফলে ফেইস থাকে ক্লিন ও হেলদি, কমে যায় একনে, বাম্পস ইত্যাদি হওয়ার চান্স।
কেন করবো?
আমরা বাইরে বের হওয়ার সময় মেকআপ করি, বিভিন্ন স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টস অ্যাপ্লাই করি, সারাদিন বাইরের ধুলোবালি, ময়লা, বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদি আমাদের স্কিনে জমে থাকে। এগুলো ঠিকমতো ক্লিন না হলে একনে, বাম্পস, ডেড সেলস বাড়তে থাকে। এছাড়া এগুলো জমে থেকে পোরস ক্লগ করে দেয়, স্কিনের উপর ময়লার স্তর তৈরী করে, তাই স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টস ঠিকমতো স্কিনের গভীরে ঢুকতে পারে না। স্কিনের স্বাভাবিক কার্যক্রমেরও ব্যাঘাত ঘটে ফলে, নানা রকম অসুবিধা ও ক্ষতি হয় ত্বকের। এজন্য স্কিন হেলদি রাখতে ডাবল ক্লিনজিং অত্যন্ত উপকারী।
ডাবল ক্লিনজিং যে সকল বেনিফিটস দেয়-
স্কিনের হাইড্রেশন ধরে রাখে
ডাবল ক্লিনজিং স্কিনকে হাইড্রেট রাখে। যেহেতু ফার্স্ট ওয়াশে ময়লা, মেকআপ রেসিডিউ ক্লিন হয়ে যায় এবং পরের ধাপে ক্লিনজার ইউজ করা হয় তাই এটি ত্বকের স্বাভাবিক আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি স্কিনের বাইরের ব্যারিয়ারকে ব্যাক্টেরিয়া ও ক্ষতিকর সব জিনিস থেকে রক্ষা করে, ফলে স্কিনের সেলগুলো তার স্বাভাবিক কাজ করতে পারে ভালোভাবে। তাই স্কিন থাকে হেলদি ও ইয়াংগার লুকিং।
ত্বকে ব্ল্যাকহেডস বা একনে হওয়ার চান্স কমায়
আমাদের ত্বকের ময়েশ্চার ধরে রাখার জন্য এবং ত্বককে ব্যাকটেরিয়া থেকে সুরক্ষিত রাখতে স্কিনের ভেতরে থাকা সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড সিবাম নামক অয়েল প্রডিউস করে। হেয়ার ফলিকল এই গ্ল্যান্ড থেকে সিবামকে স্কিন সারফেসে আসতে সাহায্য করে। স্কিনের সারফেসে যদি বিল্ড আপ জমে থাকে তাহলে ফলিকল ব্লক হয়ে যেতে পারে, সিবাম ও ডেড সেলস আটকে যেতে পারে। এই ব্লকড ফলিকলকেই আমরা ব্ল্যাকহেডস নামে চিনি। আবার স্কিনের সারফেসে যদি সিবামের পরিমাণ কম থাকে তাহলে ফলিকলে ব্যাকটেরিয়া পেনিট্রেট হয়ে ইনফ্ল্যামেশন হতে পারে। এতে একনে হওয়ার চান্স বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে হার্শ ক্লিনজার ব্যবহার করা যাবে না, কারণ মাইক্রোবায়োম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ন্যাচারাল অয়েল ধুয়ে যেতে পারে। এতে অয়েল প্রোডাকশনের চান্স বেড়ে যায় এবং স্কিন কন্ডিশন আরও খারাপ হতে পারে। ডাবল ক্লিনজিং কোনোরকম ময়লা বা ব্যাক্টেরিয়া ত্বকে জমতে দেয় না এবং ত্বকের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করে। যার কারণে ব্ল্যাকহেডস বা একনে হওয়ার চান্স কমে যায়।
ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে
ডাবল ক্লিনজিং নিয়মিত করলে ত্বক হয়ে ওঠে রেডিয়েন্ট ও হেলদি। কারণ ত্বকে কোনো ময়লা বা ক্ষতিকর জিনিস জমে থাকে না,ফলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে।
স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টস স্যুট হতে সাহায্য করে
ডাবল ক্লিনজিং স্কিনকেয়ার বিভিন্ন প্রোডাক্টস যেমন- সিরাম, টোনার, মাস্ক, ময়েশ্চারাইজার ইত্যাদিকে সঠিক ও ভালোভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। কমে যায় পোরস ক্লগ হওয়ার চান্স।
অয়েল প্রোডাকশন কন্ট্রোল করে
ডাবল ক্লিনজিং ত্বকের হাইড্রেশন ব্যালান্স করে এবং অতিরিক্ত অয়েল প্রোডাকশন কন্ট্রোল করে।
কীভাবে করবো?
ডাবল ক্লিনজিং খুবই সহজ একটি মেথড। তবে আপনাকে অবশ্যই আপনার স্কিন টাইপ বুঝে ক্লিনজার ও ফেইসওয়াশ বেছে নিতে হবে। ডাবল ক্লিনজিং এর স্টেপগুলো হলো-
১। প্রথমে একটি ক্লিনজিং অয়েল, মাইসেলার ওয়াটার অথবা ক্লিনজিং বাম দিয়ে মেকআপ সহ পুরো ফেইস ভালোভাবে ক্লিন করতে হবে। কটনপ্যাডে নিয়ে আলতো করে ঘষে ঘষে একটু সময় নিয়ে পরিষ্কার করতে হবে যেন মেকআপ রেসিডিউ, ধুলো-ময়লা, স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টস রেসিডিউ ক্লিন হয়ে যায়। ত্বকের ধরন বুঝে ক্লিনজার সিলেক্ট করুন।
২। এবারে ফেইসওয়াশ বা ক্লিনজিং সোপ হাতে নিয়ে ফোম তৈরী করে মুখে অ্যাপ্লাই করুন। আলতো করে ঘষে নিন। জোরে জোরে কোনোভাবেই রাব করা যাবে না। এতে ত্বকের ক্ষতি হতে পারে। এরপর পানি দিয়ে ভালোভাবে মুখ ধুয়ে ফেলুন। এক্ষেত্রে আপনার স্কিনে স্যুট করে এমন জেল, ক্রিম অথবা ওয়াটার বেইজড ক্লিনজার বেছে নিতে পারেন।
তো এই হলো ডাবল ক্লিনজিং এর দুটি স্টেপ। এরপর আপনার প্রতিদিনের স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টস অ্যাপ্লাই করুন। নিয়মিত ডাবল ক্লিনজিং করলে ফেইস ঠিকভাবে ক্লিন হবে আর থাকবে সফট, ব্রাইট ও হেলদি।
কখন করা উচিত?
সাধারণত দিনে একবার ডাবল ক্লিনজিং করলেই যথেষ্ট। যেহেতু সারাদিনে আমাদের স্কিনে সব ময়লা, ব্যাক্টেরিয়া, মেকআপ রেসিডিউ ইত্যাদি জমে থাকে তাই ডাবল ক্লিনজিং সন্ধ্যায় বা রাতেই করা সবচেয়ে উত্তম। তবে রাতে যদি অয়েল বেইজড বা বেশ কয়েকটি প্রোডাক্ট ইউজ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে সকালেও ডাবল ক্লিনজিং করে নেয়া ভালো।
কারা করতে পারবে?
যেহেতু টিনেজ বয়স থেকেই স্কিনকেয়ার করা শুরু করলে ভালো, তাই ডাবল ক্লিনজিং এর অভ্যাসটাও এ সময় থেকেই করা গেলে বেশ ভালো হয়। ছেলে হোক বা মেয়ে, ডাবল ক্লিনজিং টিনেজ বা এর উপরের যেকোনো বয়সের যে কারো জন্য ভালো। প্রোপারলি স্কিন ক্লিনের রুটিন বিল্ড আপ করতে পারলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্কিনের যে সমস্যাগুলো হয়ে থাকে তা থেকেও অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যায়।
স্কিন টাইপ অনুযায়ী ক্লিনজার বেছে নিন
আমরা অনেক সময় ভাবি, ক্লিনজারই তো, পরিষ্কারই করবে, এর আবার এত বাছাবাছির কী আছে? কিন্তু ক্লিনজার আপনার ত্বককে পরবর্তীতে হতে যাওয়া বিভিন্ন স্কিন প্রবলেম থেকে সুরক্ষিত রাখবে। স্কিনে ক্লিনজার স্যুট না করলে হতে পারে একনে, বাম্পস, ইরিটেশন ইত্যাদি। এজন্য টেস্ট করে নেয়া সবচেয়ে ভালো। ত্বকের ধরন অনুযায়ী ক্লিনজার সিলেকশন সম্পর্কে কিছু সাজেশন দেয়া হলো এখানে।
নরমাল স্কিন
নরমাল স্কিনে সাধারণত যেকোনো প্রোডাক্টই মানিয়ে যায় সহজে, তাই খুব একটা সমস্যা হয় না। তবুও যদি ময়েশ্চারাইজিং বা ক্রিমি ফর্মুলার ক্লিনজার বেছে নেয়া হয় সেটি বেশ ভালো হয়।
ড্রাই ও সেনসিটিভ স্কিন
স্কিন রিলেটেড যেকোনো প্রোডাক্টস অ্যাপ্লাই করার আগে ড্রাই বা সেনসিটিভ স্কিনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতেই হয়। তা না হলে ইরিটেশন, বাম্পস, একনে এগুলো হতে সময় লাগে না। তাই ড্রাই বা সেনসিটিভ স্কিন হলে ক্লিনজার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্কিনের পিএইচ লেভেল ব্যালান্স করে, ময়েশ্চারাইজিং, জোজোবা অয়েল বা সিয়া বাটার আছে এ ধরনের ক্লিনজার বেছে নিন। ক্লিনজার যেন বেশি স্ট্রং না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
অয়েলি ও একনে প্রন স্কিন
অয়েলি বা একনে প্রন স্কিনের ক্ষেত্রে লাইটওয়েট এবং অয়েল কন্ট্রোল করে এ ধরনের ক্লিনজার বেছে নিলে ভালো হয়। বিশেষ করে একনে প্রন স্কিনের জন্য অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান যেমন- ভিটামিন ই ও গ্লাইকোলিক অ্যাসিড আছে এ ধরনের ক্লিনজার হলে ভালো হবে।
কম্বিনেশন স্কিন
কম্বিনেশন স্কিনের ক্ষেত্রে এমন ক্লিনজার বেছে নিন যেটি স্কিনের অয়েল কন্ট্রোলের পাশাপাশি ময়েশ্চারাইজড রাখবে, স্কিন ড্রাই করে ফেলবে না। তাই এমন ক্লিনজার নিন যেটিতে ময়েশ্চারাইজিং সিরামাইডস থাকবে।
এই তো জেনে নিলেন ডাবল ক্লিনজিং এর ব্যাপারে সবকিছু। এটি প্রতিদিনের স্কিনকেয়ারের আগে করে নিলে অভাবনীয় বেনিফিটস পাওয়া যায়। তাই যতই ব্যস্ত থাকুন, দিনশেষে হেলদি স্কিন পেতে ডাবল ক্লিনজিংকে একটি অভ্যাস বানিয়ে নিন।
Leave a comment