রিয়া আয়নার সামনে বসে খেয়াল করলো তার ফেস এর কিছু জায়গার রং বেশ গাঢ় হয়ে গিয়েছে। ফেসের এই দাগগুলো মেকআপ করার পরও বেশ ভালো বোঝা যাচ্ছে। রিয়ার খুবই মন খারাপ হলো।
তানিয়া খুব সুন্দর করে সেজেগুজে গলায় মালা পরতে যেয়ে খেয়াল করলো তার গলায় এবং ঘাড়ে বেশ কালো দাগ। বার বার নানা জিনিস দিয়ে পরিষ্কার করেও সেগুলো দূর করতে পারলো না।
দুটো ঘটনাই খুব স্বাভাবিক স্কিন প্রবলেম এবং আমাদের মাঝে অনেকের ক্ষেত্রেই প্রায়শই দেখা দিয়ে থাকে। এগুলো হাইপারপিগমেন্টেশন নামে পরিচিত। আজকে এই হাইপারপিগমেন্টেশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
হাইপারপিগমেন্টেশন কী?
মূলত স্কিনের কোন অংশের রং অন্যান্য অংশের চেয়ে গাঢ় হয়ে গেলে তাকে হাইপারপিগমেন্টেশন বলে। ত্বক, চুল, চোখের রেটিনা ইত্যাদির রং আসে মেলানিন নামের একটি পিগমেন্ট থেকে যা তৈরী করে থাকে মেলানোসাইট নামের একটি কোষ। মেলানিন হলো একটি রঞ্জক পদার্থ, এটির উৎপাদন কোন কারনে বেড়ে গেলে হাইপারপিগমেন্টেশন দেখা দেয়।
হাইপারপিগমেন্টেশন শরীরের যেকোন স্থানে দেখা দিতে পারে তবে সাধারনত ফেস এ বেশি দেখা যায়। এশীয়দের মাঝে এ ধরনের সমস্যাগুলো হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে যেহেতু তাদের ন্যাচারালিই ডার্ক স্কিন হয়ে থাকে ফলে স্কিনে মেলানিন এর উপস্থিতি বেশি হয়।
হাইপারপিগমেন্টেশন কেন হয়?
হাইপারপিগমেন্টেশন নানা কারনে হয়ে থাকে। চলুন জেনে নিই কেন হাইপারপিগমেন্টেশন দেখা দিতে পারে।
সান এক্সপোজার
সূর্যের ক্ষতিকর ইউভি রশ্মি ত্বকের নানা ক্ষতির পাশাপাশি মেলানিন প্রোডাকশন বুস্ট আপ করে থাকে। পরিমিত মাত্রায় মেলানিন ইউভি রশ্মির ক্ষতি থেকে ত্বককে যেমন রক্ষা করে তেমন অতিরিক্ত সান এক্সপোজার মেলানিন প্রোডাকশন বাড়িয়ে দেয়। ফলে সানট্যান থেকে শুরু করে সানবার্ণ এবং হাইপারপিগমেন্টেশন দেখা দেয়।
স্কিন ইনফ্ল্যামেশন
যেকোন ধরনের স্কিন ইনফ্ল্যামেশন বা স্কিন ট্রমা যেমন কাটাছেঁড়া, আঘাত, একনে ব্রেকআউট, যেকোন ক্ষত এর কারনে হাইপারপিগমেন্টেশন তৈরী হতে পারে। এমন কি ব্রন খুটিয়ে তুললেও অনেক সময় এই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। সাধারনত কোন কারনে স্কিনের ব্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্থ হলে স্কিন হিলিং প্রসেসের কারনে সেখানে মেলানিন উৎপাদনও বেড়ে যায়। ফলে সে জায়গার রং অন্য জায়গা থেকে বেশি গাঢ় দেখা যায়। একে পোস্ট-ইনফ্ল্যামেটোরি হাইপারপিগমেটেশন ও বলে।
হরমোনাল পরিবর্তন
শারীরিক বিভিন্ন অবস্থার জন্য হরমোনাল পরিবর্তন আসা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। হরমোনাল এই পরিবর্তনের কারনে মেলানোসাইট সেল এর কাজও ইম্ব্যালান্স হয়ে মেলানিন প্রোডাকশন বেড়ে যেতে পারে। যেমন প্রেগ্ন্যান্সি, থাইরয়েড ইত্যাদির কারনে হাইপার পিগমেন্টেশন দেখা দেয়।
জেনেটিক্স এর জন্য
অনেক সময় বংশে হাইপারপিগমেন্টেশনের ইতিহাস থাকলে এটি হতে পারে।
শারীরিক অসুস্থতা
কিছু কিছু শারীরিক অসুস্থতা যেমন ডায়বেটিস, এডিসন ডিজিজ, পিসিওস ইত্যাদির কারনে হাইপারপিগমেন্টেশন হয়ে থাকে।
আবহাওয়ার কারনে
অতিরিক্ত ধূলোবালি, পল্যুশন স্কিনের অনেক ক্ষতি করে থাকে। এ সকল কারনে স্কিন ব্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। স্কিন ব্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হলে মেলানিন উৎপাদন বেড়ে গিয়ে হাইপারপিগমেন্টেশন এর সৃষ্টি হতে পারে।
হেভি মেটাল এক্সপোজার
সান এক্সপোজারের মত কিছু কিছু হেভি মেটাল কনটেন্ট যেমন আর্সেনিক, আয়রন, লেড ইত্যাদির সংস্পর্শে বেশি আসলে হাইপারপিগমেন্টেশন দেখা দিতে পারে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
অনেক সময় কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হাইপারপিগমেন্টেশন হতে পারে।
অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন
কোন ওষুধ, স্কিনকেয়ার, মেকআপ প্রোডাক্টস যা স্কিনে স্যুট করেনা তা ব্যবহার করলে অ্যালার্জিক রিয়্যাকশনের কারনেও হাইপারপিগমেন্টেশন দেখা দিতে পারে।
হাইপারপিগমেন্টেশন কত প্রকার?
হাইপারপিগমেটেশন এর ধরন অনুযায়ী এটি কয়েক প্রকার হয়ে থাকে যেমনঃ
- মেলাসমা বা মেছতা
- সানস্পটস
- পোস্ট ইনফ্ল্যামেটরী হাইপারপিগমেন্টেশন
- ফ্রেকলস বা এফিলাইডস
- পেরিঅরবিটাল হাইপারপিগমেন্টেশন বা চোখের পাতার হাইপারপিগমেন্টেশন
- ম্যাচুরেশনাল হাইপারপিগমেন্টেশন যা বয়স, জেনেটিক, সান এক্সপোজার বা নির্দিষ্ট কিছু রোগের কারনে হয়ে থাকে।
হাইপারপিগমেন্টেশন থেকে বাঁচার উপায় কি?
হাইপারপিগমেন্টেশন অবশ্যই একটি দুশ্চিন্তার কারন। এটি কেন হচ্ছে তা জানার জন্য অভিজ্ঞ ডার্মাটোলজিস্ট এর সাথে কনসাল্ট করা অবশ্যই জরুরি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিছু স্কিনকেয়ার রুটিন ফলো করলে এ থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব। চলুন তবে জেনে নিই কিভাবে আমরা কিছু রেগুলার স্কিনকেয়ার করে হাইপারপিগমেন্টেশন থেকে রক্ষা পেতে পারি।
সূর্যরশ্মি থেকে থাকুন দুরে
সূর্যরশ্মি মেলানিন প্রোডাকশন বুস্ট করে, সানবার্ন করে যার কারনে হাইপারপিগমেন্টেশন হওয়ার চান্স তৈরি হয় এবং যদি হাইপারপিগমেন্টেশন থাকে তবে তা আরো বেড়ে যায়। তাই সুর্যরশ্মি থেকে বাঁচতে বাইরে বের হলে দিনের বেলায় অবশ্যই সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে।
ব্যবহার করুন ভিটামিন সি সিরাম
ভিটামিন সি সিরাম কোলাজেন প্রোডাকশন বুস্ট করে যা স্কিনে নতুন সেল প্রোডাকশন বাড়ায়। সানবার্ন বা যেকোন ধরনের দাগ কমায় ভিটামিন সি সিরাম, স্কিন ময়েশ্চারাইজড ও হাইড্রেটেড রাখে। ফলে হাইপারপিগমেন্টেশন হওয়ার চান্স কমে যায়।
আপনাদের ত্বকের যত্নে গুরুত্বপূর্ণ এই সিরামটি নিয়ে এসেছে স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ড অরগানিকাওন। ভিটামিন সি হাইড্রো বুস্টিং গ্লোয়িং সিরামে সব উপাদান রয়েছে ত্বকের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে। এটি ত্বকের গ্লো ফেরানোর পাশাপাশি বাড়াবে আপনার ত্বকের কোলাজেন উৎপাদন।
ব্যবহার করুন রেটিনল
রেটিনল হলো ভিটামিন বি১ এর একটি ফর্ম, যা বর্তমানে বিউটি প্রোডাক্টসে বহুল ব্যবহৃত একটি জিনিস। ভিটামিন এ আমাদের শরীর ও ত্বকের জন্য অনেক বেশি উপকারী। খাবারের পাশাপাশি স্কিনের জন্যও বর্তমানে নানাভাবে ভিটামিন বি অ্যাপ্লাই করা হয়ে থাকে। রেটিনলের সবচেয়ে বড় কাজ হলো ডেড স্কিন সেলস রিমুভ করা। যত বেশি ডেড স্কিন সেলস রিমুভ হবে তত নতুন সেলস প্রডাকশন বাড়বে এবং হাইপারপিগমেন্টেশন দূর হবে। তাই ভালো কোন রেটিনল রাখুন স্কিনকেয়ার রুটিনে।
কুমকুমাদি অয়েল ম্যাসাজ করুন
ম্যাসাজিং শরীরের জন্য অনেক উপকারী। হাইপারপিগমেন্টেশন কমাতেও অয়েল ম্যাসাজ বেশ ভালো কাজ করে। এক্ষেত্রে একটি ভালো মানের ফেসিয়াল অয়েল হলে দারুন রেজাল্ট পাওয়া যায়। অর্গানিকাওনের কুমকুমাদি অয়েল হাইপারপিগমেন্টেশন কমাতে বেশ ভালো কাজ করে। এতে স্যাফরন, চন্দন, হলুদ, নারকেল তেলের মত উপকারী সব প্রাকৃতিক উপাদানের নির্যাস রয়েছে যা ডার্ক সার্কেল সহ পিগমেন্টেশন দূর করে, স্কিন ব্রাইট করে। তাই নিয়মিত এই অয়েল দিয়ে ফেস ম্যাসাজ করলে হাইপারপিগমেন্টেশন দূর করতে পারবেন।
অভিজ্ঞ ডার্মাটোলজিস্ট এর পরামর্শ নিন
হাইপারপিগমেন্টেশনের কারন ও প্রিভেন্টেশনের জন্য অভিজ্ঞ ডার্মাটোলজিস্ট এর সাথে কনসাল্ট করুন। সাধারনত নরমাল হাইপারপিগমেন্টেশনের ক্ষেত্রে হাইড্রোকুইনোন, এজিলিক এসিড, আলফা আরবুটিন, কোজিক এসিড, নিয়াসিনামাইডযুক্ত প্রোডাক্টস ডার্মাটোলজিস্টরা সাজেস্ট করে থাকেন। তাই কোনটি কি মাত্রায় ব্যবহার করা উচিৎ জানতে অবশ্যই ডার্মাটোলজিস্ট এর পরামর্শ নিন।
এছাড়াও বর্তমানে লেজার সার্জারি, কেমিক্যাল পিল এর মত অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাও আছে তাই এ ধরনের স্কিনকেয়ারে কাজ না হলে অভিজ্ঞ ডার্মাটলজিস্ট এর সাহায্যে সহজেই হাইপারপিগমেন্টেশনের জন্য ট্রিটমেন্ট নিতে পারবেন।
হাইপারপিগমেন্টেশন হলে তার কোন প্রতিকার নেই এটা ঠিক নয়। সঠিক কারন জেনে ধৈর্য্য ধরে সঠিক স্কিনকেয়ার করতে থাকলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাই হাইপারপিগমেন্টেশন দেখা দিলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও হতাশ না হয়ে স্কিনকেয়ারে মনোযোগ দিন। কড়া রোদ এড়িয়ে চলুন, ছাতা, সানগ্লাস ও ক্যাপ ব্যবহার করুন। হেলদি লাইফস্টাইল মেইনটেইন করুন। অল্প কিছু অভ্যাসেই হাইপারপিগমেন্টেশন প্রতিরোধ করা সম্ভব।
Leave a comment