বর্তমানে যারাই একটু হেলথ কেয়ার বা স্কিনকেয়ার নিয়ে একটু সচেতন, তাদের সবার কাছেই কোলাজেন শব্দটি বেশ পরিচিত। ইদানীং শব্দটি আমরা প্রায়ই শুনতে পাই। তবে আমরা কি জানি কোলাজেন কী বা এর কাজ কী? এটি কি আমাদের জন্য উপকারী না ক্ষতিকর? চলুন তাহলে আজ আমরা কোলাজেন সম্পর্কে জেনে নেই।
কোলাজেন কী?
এক কথায় যদি আমরা বলি তাহলে কোলাজেন হলো আমাদের শরীরের প্রাকৃতিক প্রোটিন। তবে এটির কাজ অনেক এবং এটি আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। অ্যামিনো এসিড থেকে মূলত প্রোটিন তৈরী হয়। কোলাজনের অ্যামিনো এসিডের মূল উপাদান হলো প্রোলিন, গ্লাইসিন এবং হাইড্রোক্সিপ্রোলিন। এই অ্যামিনো এসিডগুলো শরীরের মাঝে থাকা জিংক, ভিটামিন সি ইত্যাদির সাহায্যে একত্রিত হয়ে কোলাজেন তৈরী করে। আমাদের শরীরের মোট প্রোটিনের মাঝে ৩০% ই হলো কোলাজেন। এটি ত্বক, পেশি, হাড়, লিগামেন্ট এবং অন্যান্য কানেক্টিভ টিস্যু ইত্যাদি তৈরীর প্রাথমিক উপাদান। এছাড়াও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, রক্ত, এমনকি ইন্টেস্টাইনের আবরণেও কোলাজেন পাওয়া যায়। কাজেই বুঝতে পারছেন কোলাজেন আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান।
কোলাজেনকে বলা হয়ে থাকে “ফাউন্টেন অফ ইয়ুথ”। প্রাচীনকাল থেকেই নারীরা রিংকেলস, ফাইন লাইন্স এগুলো এড়াতে কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার খেতেন। ১৯৮০ সাল থেকে কোলাজেন ইনজেকশন আকারে পাওয়া যেতে থাকে। যদি একটু ব্যয়বহুল ছিলো। তবে বর্তমানে খাবার হিসেবে বিভিন্ন ক্রিমার, স্যাশে, ক্যাপসুল ইত্যাদির পাশাপাশি স্কিনকেয়ারের জন্য কোলাজেন সমৃদ্ধ লোশন, সিরাম, মেডিকেল ক্রিম ইত্যাদি হিসেবেও পাওয়া যায়। সহজলভ্য হওয়ায় বর্তমানে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের মাঝে এই কোলাজেন সমৃদ্ধ প্রোডাক্টগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ত্বকের জন্য কোলাজেনের উপকারিতা
কোলাজেন কী তা তো আমরা জানলাম, এখন জানার বিষয় আসলে কোলাজেন আমাদের স্কিনে কী কী বেনিফিটস দেয়।
স্কিন হেলথ ইম্প্রুভ করে
কোলাজেন স্কিনের প্রাইমারী উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি স্কিন ব্যারিয়ার স্ট্রং করার পাশাপাশি ইলাস্টিসিটি বাড়ায় এবং হাইড্রেট রাখে। বয়স বাড়তে থাকলে কোলাজেন প্রোডাকশন কমতে থাকে ফলে স্কিন ড্রাই হতে থাকে বেশি এবং রিংকেলস দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, কোলাজেন পেপটাইড বা কোলাজেন সাপ্লিমেন্টগুলো স্কিন ড্রাইনেস থেকে রক্ষা করে ফলে রিংকেলস হতে পারে না এবং স্কিন এজিং প্রসেস স্লো হয়। ভিয়েতনাম ও তাইওয়ানের ২৬ টি মেডিকেল ইউনিভার্সিটির একসাথে করা মহিলাদের উপর একটি রিসার্চে দেখা যায়, যারা ৪ থেকে ১২ সপ্তাহে প্রতিদিন ১ থেকে ১২ গ্রাম করে কোলাজেন নিয়েছেন তাদের স্কিন আগের থেকে হাইড্রেট হয়েছে এবং ইলাস্টিসিটি বেড়েছে।
স্কিনের ব্লাড ফ্লো ইম্প্রুভ করে
আমাদের ব্লাড সার্কুলেশন সিস্টেমের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো কোলাজেন। কোলাজেন প্রোডাকশন বাড়লে তা রক্তনালীগুলোকে শক্তিশালী করে তোলে। ফলে স্কিনে রক্ত প্রবাহ বাড়ে এবং স্কিন তার প্রয়োজনীয় কাজ ঠিকভাবে করতে পারে। যার ফলে স্কিন থাকে হেলদি, রেডিয়েন্ট ও গ্লোয়িং।
স্কিনের ইলাস্টিসিটি বাড়ায়
কোলাজেন স্কিনের ইলাস্টিসিটি বাড়ায়। ইলাস্টিসিটি মূলত কী? আসলে ইলাস্টিসিটি হলো স্কিনের সেই বৈশিষ্ট্য যার ফলে স্কিন নাড়াচাড়া করা হলে, হাসলে বা মুভমেন্ট করলে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। অর্থাৎ স্কিনে ভাঁজ না পড়ার যে বৈশিষ্ট্য তাকেই ইলাস্টিসিটি বলা হয়ে থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের স্কিনে কোলাজেন প্রোডাকশন কমতে থাকে। ফলে দেখা দেয় ফাইন লাইন্স, রিংকেলস। কোলাজেন এগুলো থেকে আমাদের স্কিন রক্ষা করে। ফলে স্কিন হয় আরো ইয়াংগার লুকিং ও হেলদি।
ফাইন লাইন্স ও রিংকেলস কমায়
সূর্যের ক্ষতিকর ইউভি রশ্মি, দূষণ, ধুলোবালি, ক্লান্তি ইত্যাদি কোলাজেন প্রোডাকশন কমিয়ে দিতে পারে। এতে হারিয়ে যেতে পারে স্কিনের ইলাস্টিসিটি, দেখা দিতে পারে ফাইন লাইন্স ও রিংকেলস, বুড়িয়ে যেতে পারে চেহারা। কোলাজেন প্রোডাকশন ঠিকমতো হলে এগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কমে যেতে থাকে ফাইন লাইন্স ও রিংকেলস। এজিং প্রসেস স্লো হয়। ফলে স্কিন থাকে ইয়াংগার লুকিং।
ডার্ক স্পট রিমুভ করে
সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি স্কিনের কোষ ড্যামেজ করে মেলানিন প্রোডাকশন বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে স্কিনে দেখা দিতে পারে ডার্ক স্পট, কমে যেতে পারে স্কিনের গ্লো। কোলাজেন নতুন কোষ উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। ফলে ড্যামেজড কোষ দূর হয় এবং মেলানিন প্রোডাকশন কমে যায়। ফলে আপনার স্কিনের ডার্ক স্পট দূর হয়, স্কিন হয় গ্লোয়িং।
ক্ষত সারিয়ে তোলে
অনেক সময় একনে, র্যাশ, ইরিটেশন, সানট্যান ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে আমাদের স্কিনে ক্ষত তৈরী হয়ে থাকে। কোলাজেন নতুন সেলস প্রোডাকশন, ব্লাড সার্কুলেশন বাড়িয়ে বিভিন্ন স্কিন ড্যামেজ, ক্ষত এগুলো সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে।
শরীরের জন্য কোলাজেনের উপকারীতা
শুধু স্কিনের জন্যই যে কোলাজেন উপকারী তা নয় বরং শারীরিক নানা উপকারও করে থাকে এই উপাদানটি। চলুন জেনে নিই আমাদের শরীরের জন্য কোলাজেন কী কী উপকার করে থাকে।
- শরীরের বিভিন্ন হাড়ের জয়েন্টে যে ব্যথা হয় সেগুলো উপশম করতে সাহায্য করে থাকে। আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে গবেষণা করে দেখা গেছে যে, নিয়মিত কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের ফলে তাদের হাড়ের জয়েন্টের দৃঢ়তা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
- কোলাজেন হারের ক্ষয় রোধ করে। হাড়ের বেশিরভাগটাই কোলাজেন দিয়ে তৈরী। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোলাজেন কমতে থাকলে হাড় দুর্বল হতে থাকে, কমতে থাকে ঘনত্ব। তাই কোলাজেন বুস্ট করে এমন খাবার অথবা কোলাজেন সাপ্লিমেন্টস নিয়মিত গ্রহণ করলে হাড়ের ক্ষয় রোধ হয়।
- কোলাজেন পেশী মজবুত করে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত কোলাজেন নিয়ে থাকেন তাদের পেশী তুলনামূলকভাবে বেশী দৃঢ় এবং ঘনত্বও বেশি।
- গবেষণায় দেখা গেছে কোলাজেন হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে থাকে। কোলাজেন ধমনীর ব্লাড ফ্লো বুস্ট করে থাকে। কোলাজেনের অভাবে ধমনী তার ইলাস্টিসিটি ও ফ্লেক্সিবিলিটি হারাতে ফলে। ফলে হার্ট প্রোপার ফাংশন করতে পারে না এবং স্ট্রোক ও হার্ট এটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই নিয়মিত কোলাজেন ইন্টেক হলে হার্ট ভালো থাকে।
- নিয়মিত কোলাজেন ইন্টেক করলে বা কোলাজেন প্রোডাকশন বুস্ট হলে চুল ও নখ মজবুত ও সুন্দর হয়ে ওঠে। কোলাজেন চুল ও নখ দৃঢ় করে তোলে। ফলে এগুলো সহজে ভেঙে যায় না।
তো আপনারা জেনে গেলেন কোলাজেন আমাদের শরীরের জন্য কতটা উপকারী। কোলাজেন বর্তমানে নানাভাবে, নানা ফর্মে পাওয়া যায়। স্কিনকেয়ার হোক বা খাবার- যে কোনোভাবেই কোলাজেন ইন্টেক করা যায়। সাথে স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল, নিয়মিত ডিম, দুধ, সামুদ্রিক মাছ খাওয়া, শরীর চর্চা করা এরকম কিছু দারুণ অভ্যাসের মাধ্যমে ন্যাচারালি শরীরের কোলাজেন প্রোডাকশন বুস্ট করতে পারেন।
Leave a comment