চুল পড়া সমস্যা ও তার প্রতিকার

“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা..”

 

বাঙালী মেয়েদের চুল নিয়ে এরচেয়ে দারুণ রোমান্টিক লাইন বুঝি আর হয় না। আর আমরাও ঠিক এমনই চুল চাই যা ঘন ও ঝলমলে। কিন্তু চুল পড়া সমস্যা বর্তমানে খুবই কমন একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু মেয়েদেরই নয় বরং ছেলেরাও এই সমস্যার থেকে রেহাই পায় না। আমাদের ব্যস্ত লাইফস্টাইলে হয়তো আমরা এমন কিছু করছি যা অজান্তে এই সমস্যাটি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে এর সমাধান কী? চলুন আজকে তাহলে চুল পড়া ও তার প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত জানি।

 

চুল কেন পড়ে?

চুল পড়ার নানা কারণ থাকতে পারে। আমেরিকান একাডেমি অফ ডার্মেটোলজির তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ১০০ টি চুল পড়া স্বাভাবিক ব্যাপার। যে চুলগুলো পড়ে যাচ্ছে তার জায়গায় আবার নতুন চুল গজাবে। তবে এর বেশি  চুল পড়লে কনসার্ন হওয়া উচিত এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। অতিরিক্ত হেয়ারফলের জন্য আমাদের ডায়েট, লাইফস্টাইল অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী। এছাড়াও যে সকল কারণে হেয়ারফল হয়ে থাকে:

 

১। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও স্ট্রেস:

দুশ্চিন্তা ও স্ট্রেস শারীরিক নানা সমস্যা তৈরি করে। তার মধ্যে একটি হলো চুলের বৃদ্ধিতে বাঁধা দেয়া। সাধারণত চুলের বৃদ্ধি ঘটে চারটি পর্যায়ে- অ্যানাজেন, ক্যাটাজেন, টেলজেন এবং অ্যাক্সোজেন। প্রথম তিনটি পর্যায়ে চুল বৃদ্ধি পায় এবং চতুর্থ পর্যায়ে চুল ঝরে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা স্ট্রেস অতিরিক্ত হয় তাহলে সেটি অ্যাক্সোজেন পর্যায়টিকে এগিয়ে নিয়ে আসে ফলে চুল অতিরিক্ত হারে পড়তে থাকে। এছাড়া পর্যাপ্ত ঘুম না হলেও স্ট্রেস লেভেল বেড়ে যেয়ে বেশি বেশি চুল পড়তে থাকে।

 

২। হরমোনাল ইমব্যালান্স:

চুলের বৃদ্ধি অথবা ঝরে পড়ার সাথে বিভিন্ন হরমোন সরাসরি কাজ করে থাকে। থাইরয়েড হরমোনের ইমব্যালান্সে চুল পড়ার হার প্রচুর বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও কর্টিসল, অ্যাস্ট্রোজেন, টেস্টোস্টেরন ইত্যাদি হরমোনগুলো চুলের বৃদ্ধির সাথে সরাসরি কাজ করে। এগুলো ইমব্যালান্স হলেও চুল পড়া বেড়ে যায়। 

 

৩। পুষ্টিকর খাবার না খাওয়া:

পুষ্টিকর খাবার আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করে এবং চুলকেও সুস্থ ও সুন্দর রাখতে সাহায্য করে। শরীরে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন, আয়রন, প্রোটিন ইত্যাদি না থাকে তাহলে চুল বেশি পড়তে শুরু করে। 

 

৪। অতিরিক্ত হিট স্টাইলিং:

চুলের নানারকম স্টাইল করতে কে না পছন্দ করে? তবে অনেক সময় এমন স্টাইলিং করতে যেয়েই আমরা চুলের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে বসি। অতিরিক্ত হিট এ চুলে ভয়াবহ ড্যামেজ হয়। এছাড়া আমরা অনেক সময়ই চুল দ্রুত শুকানোর জন্য হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করে থাকি, ব্লো ড্রাই করে থাকি। অতিরিক্ত হিটে চুলের স্ক্যাল্প দ্রুত শুকিয়ে যায় ফলে চুলের কিউটিকল ফেটে যেয়ে চুলকে আরো ভালনারেবল করে তোলে। এতে চুল পড়ার হার বেড়ে যায়।

 

৫। টাইট হেয়ারস্টাইল:

সবসময় টাইট করে চুল বেঁধে রাখলে চুলের বেশ ক্ষতি হয়। এতে হেয়ার ফলিকল ড্যামেজ হয়, স্ক্যাল্পে রক্ত চলাচল কমে যায় ফলে চুলের গোড়া আলগা হয়ে চুল বেশি ঝরতে শুরু করে। চুল টেনে বেঁধে রাখলে এটির গ্রোথও কমে যায় এবং চুল ভেঙে যেতে থাকে।

 

৬। সঠিক হেয়ারকেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার না করা:

আপনার চুলে কোন প্রোডাক্টটি স্যুট করছে এটি না পরীক্ষা করেই যেকোন প্রোডাক্ট ব্যবহার করলে তা চুলের বড়রকম ক্ষতি করে দিতে পারে। শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, হেয়ার প্যাক ইত্যাদি সব স্যুট না করলে তা চুল ড্যামেজ করে চুল পড়ার হার বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া অতিরিক্ত কেমিক্যালযুক্ত প্রোডাক্ট, কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট এগুলোও চুলের প্রচন্ড ক্ষতি করে।

 

৭। প্রেগন্যান্সি ও পিসিওএস:

প্রেগন্যান্সি ও পিসিওএস দুটো ক্ষেত্রেই হরমোনের ইমব্যালেন্স হয় প্রচুর পরিমানে। যার ফলে চুল ঝরতে থাকে। তাছাড়া এসকল ক্ষেত্রে যে সব ওষুধ খেতে হয় তাও চুল পড়ার জন্য অনেক সময় দায়ী থাকে।

 

৮। দূষণ বা পল্যুশন:

আপনি যদি বেশি পল্যুটেড এলাকায় থাকেন, চলাচল করেন তাহলে চুল পড়ার হার বাড়তে পারে। দূষিত বাতাস, পানি সবই শরীরের পাশাপাশি চুলেও ভয়াবহ ক্ষতিকর ইফেক্ট করে। তাই চুল বেশি পড়ার একটি বড় কারণ হতে পারে দূষণ।

 

৯। চুলের যত্নে সঠিক নিয়ম মেনে না চলা:

চুলের যত্নের সঠিক নিয়মগুলো মেনে না চললে চুল পড়ার হার বেড়ে যায়। ভেজা চুলে ঘুমানো, টাওয়েল দিয়ে ঘষে ঘষে চুল মোছা, বার বার চুল আঁচড়ানো, ভেজা চুল আঁচড়ানো, অতিরিক্ত গরম পানি চুলে দেয়া, অপরিষ্কার বালিশের কভারে ঘুমানো এরকম নানাবিধ কারণে চুল পড়ার হার বেড়ে যেতে থাকে।

 

চুল পড়া থেকে পরিত্রাণ পাবেন যেভাবে 

চুল কেন বেশি পড়তে পারে এটা তো আমরা জানলাম। এখন এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

অবশ্যই উপায় আছে। আসুন কিছু উপায় জেনে নিই কীভাবে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সুন্দর চুল পাওয়া যাবে:

 

১। সঠিক ডায়েট মেনে চলুন:

আপনার খাবারে যদি চুলের বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুন থাকে তবে চুল পড়া কমে চুলের বৃদ্ধি বেড়ে যাবে। খেয়াল রাখুন যেন আপনার খাবারে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন সি থাকে। সাথে জিংক, আয়রন ও প্রোটিনও থাকতে হবে। এগুলো চুল পড়া রোধ করে এবং চুলের বৃদ্ধি বাড়ায়।

 

২। অতিরিক্ত হিট এড়িয়ে চলুন:

আপনার চুলের স্টাইলিং বা শুকানোর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিট দেয়া থেকে বিরত থাকুন। হিট দিয়ে স্টাইলিং করতে গেলে অবশ্যই হিট প্রোটেক্টর ব্যবহার করতে হবে যেন চুলে তাপ সরাসরি না লাগে। ব্লো ড্রাই করতে গেলে একটু দূর থেকে করতে হবে যেন তাপ কম লাগে। অতিরিক্ত গরম পানি বা তেল চুলে ব্যবহার করবেন না।

 

৩। অয়েল ম্যাসাজ:

হেয়ার ফল কমাতে নিয়মিত অয়েল ম্যাসেজ একটি দারুণ সল্যুশন। এক্ষেত্রে হট অয়েল ম্যাসেজ বেশ ভালো কাজ করে। ম্যাসাজের কারণে স্ক্যাল্পে ব্লাড সার্কুলেশন স্বাভাবিক হয়ে হেয়ার কিউটিকল থেকে প্রোটিন ও ভিটামিন সরবরাহ হয়। ফলে চুল হয় হেলদি এবং চুল পড়া কমে। চুলের যত্নে নারিকেল তেল, ক্যাস্টর অয়েল, হারবাল অয়েল এসব বেশ ভালো কাজ করে। এক্ষেত্রে একটি দারুণ প্রোডাক্ট হলো অরগানিকাওন এর রোজমেরি+অনিয়ন হেয়ার অয়েল। এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি যা চুলের গ্রোথ বাড়ায়, হেয়ার ফল কমিয়ে চুলকে সিল্কি ও মজবুত করে তোলে।

 

৪। চুল টাইট করে না বাঁধা:

কমন হেয়ারস্টাইলগুলো যেমন পনিটেইল, উঁচু করে করা টাইট বান, পিগটেইল বা টাইট ব্রেইড এগুলোতে চুল বেশ টাইট করে বাঁধা হয়। এগুলো সবসময় করলে চুলের বেশ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নিয়মিত করতে থাকলে হেয়ার লস হতে পারে যাকে অ্যালোপেশিয়া বলে। তাই এ ধরনের হেয়ার স্টাইলগুলো করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

 

৫। সঠিক নিয়মে চুল আচড়ানো:

একদমই চুল না আঁচড়ানো বা অতিরিক্ত চুল আঁচড়ানো দুটোই চুলের জন্য ক্ষতিকর। তাই দিনে অন্তত দু বার চুল আঁচড়ানো জরুরি। চুল আঁচড়ালে স্ক্যাল্পে রক্ত চলাচল বাড়ে, হেয়ার ফলিকলস স্টিমুলেট হয়, জট বাঁধার সম্ভাবনা কমে যায়। চুলের জন্য কাঠের চিরুনি বেশ ভালো। সঠিক নিয়মে নিয়মিত চুল আঁচড়ালেও চুল পড়ার হার কমে যেতে থাকে।

 

৬। সপ্তাহে অন্তত একবার হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করা:

চুলের যত্নে সপ্তাহে অন্তত একদিন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে হেয়ার মাস্ক তৈরী করে ব্যবহার করুন। নিম, অ্যালোভেরা, আমলকি, মেথি, শিকাকাই, মেহেদি ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান গুলো চুল পড়া কমায়, চুলকে হাইড্রেট করে, চুলের ফ্রিজিনেস দূর করে, চুলের ড্যামেজ রিপেয়ার করে। এগুলো চুলকে শাইনি ও স্ট্রং করে। তাই অন্তত সপ্তাহে একবার এগুলো দিয়ে হেয়ার মাস্ক তৈরী করে চুলে ব্যবহার করুন।

কিন্তু এগুলো সব যোগাড় করে রেডি করা, সঠিক পরিমাণে মেশানো বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করতে পারেন অরগানিকাওন ব্র‍্যান্ডের হেয়ার ট্রিটমেন্ট প্যাক। এই প্যাকটি এসকল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরী এবং ব্যবহারও খুব সহজ। তাই কোন ঝামেলা ছাড়াই সপ্তাহে একদিন চুলের যত্নে প্যাকটি ব্যবহার করতে পারেন।

 

৭। পর্যাপ্ত ঘুমানো ও স্ট্রেস রিলিফ করা:

কম ঘুম, স্ট্রেস ও দুশ্চিন্তার জন্য যে হেয়ারফল হয়ে থাকে তা থেকে মুক্তি পেতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে হবে। স্ট্রে রিলিফ করতে মেডিটেশন, ইয়োগা, ডিপ ব্রিদিং সহ যে ধরনের এক্সারসাইজ গুলো আছে তা করার চেষ্টা করতে হবে।

 

৮। সঠিক হেয়ারকেয়ার প্রোডাক্ট সঠিকভাবে ব্যবহার করা:

যেকোন হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট, সেটি হোক শ্যাম্পু অথবা অয়েল- আপনার চুলে স্যুট করছে কি না তা চেক করুন। যদি আপনার চুলে স্যুট না করে তবে সেটি ব্যবহার করবেন না। প্রত্যেকটি প্রোডাক্ট ব্যবহারের নিয়ম ভালোভাবে জেনে নিয়ে সঠিকভাবে ও সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করুন। অতিরিক্ত কেমিক্যালযুক্ত প্রোডাক্ট এড়িয়ে চলুন।

 

৯। লাইফস্টাইলের ক্ষেত্রে নজর দিন:

ছোট ছোট অভ্যাসে আমাদের চুল পড়ার হার বেড়ে যেতে থাকে। খেয়াল করে সেসব কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। যেমন : ভেজা চুলে শোবেন না, রাতে হালকা করে চুল বেণী করে ঘুমোবেন, পরিষ্কার বালিশের কভার ব্যবহার করবেন, চুল মুছতে নরম টাওয়েল ব্যবহার করবেন, ভেজা চুল আঁচড়াবেন না। এ ধরনের ছোটখাটো নিত্যদিনের অভ্যাসগুলোও আপনার চুল পড়া কমিয়ে দিবে।

 

১০। চুল ঢেকে বাইরে যান:

দূষণ চুলের প্রচন্ড ক্ষতি করে। তাছাড়া বাইরে ধুলোবালি, ময়লা, সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মিও চুলের ক্ষতি করে। তাই বাইরে যাওয়ার আগে চুল ঢেকে বের হোন। স্কার্ফ বা ক্যাপ পরলে চুল অনেকটাই সুরক্ষিত থাকবে, ফলে ড্যামেজ হওয়ার আশংকাও কমে যাবে।

 

চুল পড়তে থাকলে সেটি নিয়ে হতাশ হলে হবেনা। সমস্যাটি কেন তৈরী হচ্ছে সেটি খুঁজে বের করুন এবং সেই অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট করুন। নিয়মিত হেয়ার কেয়ার রুটিন ফলো করার চেষ্টা করুন এবং হেয়ারফল বাড়িয়ে দেয় এমন কাজগুলো করা থেকে বিরত থাকুন। এরপরও যদি হেয়ারফল হতে থাকে তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।