মেথি: ছোট্ট বীজের বড় কাজ

আমাদের জীবন এখন অনেক ব্যস্ততায় কাটে। এই ব্যস্ততায় আমরা নিজেদের যত্ন নিতে ভুলে যাই। ফলে দেখা দিচ্ছে নানারকম শারীরিক ঘাটতি। পড়ে যাচ্ছে চুল, হারিয়ে যাচ্ছে ত্বকের উজ্জ্বলতা। কেমন হয় যদি সব সমস্যার সমাধান একসাথে পাওয়া যায়?

আজকে আমরা কথা বলবো এমনই একটি জাদুকরী বীজ নিয়ে যা একসাথে শারীরিক নানাবিধ উপকার তো করেই সাথে চুল ও ত্বকের যত্নেও দারুণ কার্যকরী। এই বীজটি আমাদের খুবই পরিচিত- মেথি।

কথা না বাড়িয়ে চলুন তবে জেনে নিই মেথির আদ্যোপান্ত।

 

মেথি কী?

মেথি মূলত একটি বর্ষজীবী উদ্ভিদ। আমরা সাধারণত মেথি হিসেবে যা ব্যবহার করি তা এই গাছের বীজ। এটি ইংলিশে Fenugreek নামে পরিচিত। বহুকাল ধরে ইন্ডিয়ান আয়ুর্বেদ শাস্ত্র ও চাইনিজ চিকিৎসাশাস্ত্রে এটি নানাভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। কখনো মসলা হিসেবে, কখনো ওষুধ হিসেবে আবার কখনো অন্যান্য উপাদানের সাথে মিশিয়ে ত্বক বা চুলের যত্নে। হলদে বাদামী এই বীজের স্বাদ খানিকটা তেতো হলেও গুনের কোন শেষ নেই। সাধারণত পশ্চিম এশিয়া, মধ্য ইউরোপ ও ভূ-মধ্যসাগরের কিছু অংশে এই উপকারী গাছটি জন্মে থাকে।

 

মেথির উপকারিতা

 

আগেই বলেছি, মেথির উপকারিতার কোনো শেষ নেই। এতে রয়েছে ফাইবার, প্রোটিন, কার্বস, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ ও ম্যাগিনেশিয়ামের মত উপকারী সব উপাদান। নিয়মিত মেথি ব্যবহার আমাদের যা যা উপকার করে তা হলো:

 

শারীরিক উপকারিতায় মেথি

 

১। ওজন কমাতে

আমরা অনেকেই ওজন কমাতে চাই, কারণ বাড়তি ওজন নানারকম শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে। মেথি ওজন কমাতে দারুণ কাজ করে। মেথিতে আছে ন্যাচারাল ফাইবার, তাই দিনের মাঝে দুই তিনবার চিবিয়ে খেলে ক্ষুধা কম লাগে, ফলে বাড়তি খাবার খাওয়ার হার কমে যায়। 

 

২। হজমে সাহায্য করে

মেথি হজম প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। ফলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে রক্ষা পাবেন। মেথিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইবার আছে, যা রক্তে থাকা নানারকম বিষাক্ত উপাদানের বিরুদ্ধে কাজ করে। মেথি ভেজানো পানি খেলে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যায়।

 

৩। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে:

মেথিতে আছে অ্যামিনো অ্যাসিড যা ইনসুলিন তৈরি করতে সাহায্য করে। ইনসুলিন রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে দেয়। তাছাড়া এর মাঝে থাকে গ্যালাক্টোম্যানান, যা রক্তে চিনি ও কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা কমিয়ে দেয়। তাই ডায়াবেটিস রোগীরা তাদের ডায়েট চার্টে আজই যোগ করে ফেলুন মেথি।

 

৪। কোলেস্টেরল কমাতে:

আমাদের মাঝে রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়ার সমস্যাও দিন দিন বাড়ছে। আমরা অনেকেই এই সমস্যায় ভুগছি। এই সমস্যার একটি দারুণ সমাধান হতে পারে মেথি। মেথি উচ্চ মাত্রার লাইপোপ্রোটিন এর উপর কোনো প্রভাব না ফেলেই ট্রাইগ্লিসারাইডের সাথে কাজ করে নিম্ন মাত্রার লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। এটি আপনার ইনটেস্টাইনকে কোলেস্টেরল শোষণ করতে বাঁধা দেয়। তাই নিয়মিত মেথি ভেজানো পানি খেলে কমে যায় শরীরের কোলেস্টেরল এর মাত্রা।

 

৫। হার্ট ভালো রাখতে:

মেথিতে থাকা গ্যালাক্টোম্যানান হার্ট ভালো রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া এতে আছে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম, যা সোডিয়ামের ক্ষতিকর প্রভাবের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং হার্ট রেট ও ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

 

৬। মাতৃদুগ্ধ বাড়াতে:

যে সকল মায়েরা ব্রেস্টফিড করেন, তারা মাঝে মাঝে বুকের দুধ বাড়াতে মেথি খেয়ে থাকেন। এটি বেশ উপকারী নতুন মায়েদের জন্য। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সকল ব্রেস্টফিডিং মায়েরা নিয়মিত মেথি খান তাদের মাতৃদুগ্ধের পরিমাণ যারা নিয়মিত মেথি খাননি তাদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া তাদের শিশুদের ওজনও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই ফ্রেস্টফিডিং মায়েরা মেথি তাদের ডায়েটে রাখতেই পারেন।

 

৭। মেন্সট্রুয়াল ক্রাম্পস কমাতে:

মেন্সট্রুয়াল ক্রাম্পস নিয়ে কষ্ট করছেন না এমন নারী খুঁজে পাওয়া কঠিন। দেখা গেছে মেথিতে এমন কিছু উপাদান আছে যা মেন্সট্রুয়াল ক্রাম্পস এবং পিএমএস এর অস্বস্তি দূর করতে সাহায্য করে। 

 

৮। কিডনী ভালো রাখতেঃ

মেথির মাঝে থাকা পলিফনলিক প্লাভোনয়েড কিডনীর কার্যকারিতা বাড়ায় এবং কোষের ক্ষতি প্রতিরোধ করে।

 

চুলের যত্নে মেথি

 

১। প্রাকৃতিক কন্ডিশনার

চকচকে আর সুন্দর চুল কে না চায়? এজন্য আমরা অনেক প্রোডাক্টস ব্যবহার করে থাকি। বাজারের কেমিক্যালযুক্ত কন্ডিশনার ব্যবহার না করে আজ থেকে ব্যবহার শুরু করুন মেথি। মেথি শুধুমাত্র চুলের স্ট্র্যান্ড ভালো রাখে তা-ই নয় বরং চুলের রুট ও ফলিকলস ও মজবুত করে।

 

২। চুল পড়া বন্ধ করে

চুল পড়া নিয়ে কি আপনি বিরক্ত? প্রাকৃতিক সমাধান চাচ্ছেন? তবে আপনার হেয়ার কেয়ার রুটিনে আজই যুক্ত করুন মেথি। মেথির মাঝে থাকা আয়রন, জিংক ও প্রোটিন চুল পড়া রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে ও নতুন চুল বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। 

৩। খুশকি দূর করতে

খুশকি আপনার স্ক্যাল্পকে ড্যামেজ করে চুল পড়া বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া এটির কারণে স্কিন ইরিটেশন, ইচিং এসব হয়। মেথিতে রয়েছে অ্যান্টি ফাঙ্গাল ও অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল উপাদান। যা খুব স্ট্রংলি ড্যানড্রাফ দূর করে। ফলে আপনার স্ক্যাল্প ও চুল দুটোই থাকে স্বাস্থ্যকর ও প্রাণবন্ত। সপ্তাহে মাত্র দুইবার টকদই ও ভেজানো মেথি দিয়ে পেস্ট করে হেয়ার মাস্ক বানিয়ে ব্যবহার কলেই খুশকি থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন সহজেই।

 

৪। চুল পাকা রোধে

বয়স বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই চুল পাকতে থাকে। কিন্তু যদি একদমই অল্প বয়সে চুল পাকতে শুরু করে তবে সেটি অবশ্যই একটি চিন্তার বিষয়। মেথিতে রয়েছে উচ্চমাত্রায় পটাশিয়াম যা এই অল্প বয়সে চুল পাকা রোধ করে। তাই চুল পেকে যাওয়ার সময় স্লো করতে চাইলে হেয়ার কেয়ার রুটিনে আজই যোগ করুন মেথি। আমলকীর রসের সাথে মেথির পেস্ট করে আধা ঘন্টা চুলে রেখে দিন। এরপর শ্যাম্পু করে ফেলুন। সপ্তাহে অন্তত একবার এভাবে মেথির ব্যবহার আপনার চুলের অনেক উপকার করবে।

 

ত্বকের যত্নে মেথি

 

১। ত্বক উজ্জ্বল করতে

মেথিতে থাকা ভিটামিন সি আপনার ত্বককে উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে। এছাড়া এর অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল উপাদান ত্বকের নানারকম দাগছোপ দূর করে ত্বককে পরিষ্কার করে তোলে। সপ্তাহে মাত্র একদিন ভেজানো মেথির পেস্ট তৈরি করে মুখে লাগান। তাতেই পাবেন উজ্জ্বল ও পরিষ্কার ত্বক। এছাড়া গুড়া দুধ ও মেথির পেস্ট করেও প্যাক বানিয়ে মুখে লাগাতে পারেন। এতে স্কিন সফট ও ময়েশ্চারাইজড হবে।

 

২। টোনার হিসেবেঃ

টোনার মূলত স্কিনের পি এইচ লেভেল ঠিক রাখে এবং স্কীন সফট করে। মেথিও টোনার হিসেবে কাজ করে। মেথি সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। এরপর একটি বোতলে মেথি ভেজানো পানি সংরক্ষণ করে রাখুন। আপনার ত্বকে ময়েশ্চারাইজার দেয়ার আগে এই পানিটি স্প্রে করে নিন। এভাবে টোনার হিসেবে মেথি ব্যবহার করতে পারেন।

 

৩। স্কিন হাইড্রেট ও ময়েশ্চারাইজ করতেঃ

মেথিতে পাওয়া যায় মিউকিলেজ নামের একটি জেল এর মত উপাদান যা ত্বকে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। এটি শুষ্কতা প্রতিরোধ করে স্কিনকে হাইড্রেট রাখে এবং ময়েশ্চারাইজ করে। তাই আপনার নিয়মিত স্কিনকেয়ার রুটিনে মেথির প্যাক যুক্ত করতেই পারেন। 

 

৪। এক্সফোলিয়েটর হিসেবেঃ

ত্বক এক্সফোলিয়েট করার জন্য বাজারে অনেক প্রোডাক্টস পাওয়া যায়। এর মাঝে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক ও পেট্রোলিয়াম যুক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক ইত্যাদি থাকে। এসব ইউজ করে ত্বকের ক্ষতি না করে বরং মেথির পেস্ট ইউজ করুন। ভেজানো মেথি পেস্ট করে স্ক্রাবের মত বানিয়ে আলতোভাবে ফেইসে লাগান। শুকিয়ে আসলে ধুয়ে ফেলুন। এটি শুধু ডেড সেলসই দূর করে না বরং অতিরিক্ত তেলও ফেইস থেকে ক্লিন করে ফেলে।

 

৬। ব্রণ দূর করতেঃ

যাদের ব্রণের সমস্যা রয়েছে তারা অবশ্যই মেথি ব্যবহার করে দেখবেন। এর অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল উপাদান ব্রণ দূর করতে জাদুকরী কাজ করে। একটু বেশি পরিমাণে মেথি নিয়ে ১৫ মিনিটের মত জ্বাল দিন। ঠান্ডা করে পানি ছেঁকে ফেলুন। তুলো ভিজিয়ে এই পানিটি আপনার মুখে ভালোভাবে লাগিয়ে ফেলুন। নিয়মিত এই পানি ব্যবহারে ব্রণ দূর হবে খুব সহজেই।

 

৭। অ্যান্টি-এজিং এজেন্ট হিসেবেঃ

এই ছোট ছোট হলদে বাদামী বীজগুলো আপনার ত্বক দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে। এটি রিংকেলস কমায় ও আপনার ত্বক কে তারুণ্যদীপ্ত রখে। মেথি ফ্রি রেডিক্যাল দূর করতে হেল্প করে যা রিংকলস ও কালো দাগ হওয়া থেকে বাঁচায়। মেথি ভেজানো পানি দিয়ে ফেইস মাস্ক বানিয়ে নিয়মিত ব্যবহার করে পেয়ে যান গ্লোয়িং, ইয়াং স্কিন।

 

সাইড ইফেক্টস

মেথি একটি প্রাকৃতিক উপাদান তাই এটিতে সেভাবে ক্ষতিকর কিছু দেখা যায়নি। তবে অনেক পরিমাণে একবারে খেয়ে ফেললে ডায়রিয়া হতে পারে। তাছাড়া স্কিনে ব্যবহার করলে কারো ক্ষেত্রে অ্যালার্জি হতে পারে। তাই নিয়মিত ব্যবহারের আগে অবশ্যই প্যাচ টেস্ট করে নিতে ভুলবেন না। 

 

 

একটু তেতো স্বাদের এই ছোট বীজটি তার মাঝে নানা গুনাগুন ধরে রেখেছে। এসব কাজ ছাড়াও মেথি শরীরের রক্ত শোধন করে থাকে। তাই আপনার শারীরিক নানা ঘাটতি পূরণে মেথিকে আপনার খাদ্যতালিকায় ও স্কিনকেয়ার এবং হেয়ারকেয়ার রুটিনের একটি দৈনন্দিন অনুষঙ্গ হিসেবে আজই যোগ করুন।