ব্রণ(একনি) সমস্যা নিয়ে আলাদা করে আর বলার কিছু নেই।কম বেশি সবাই আমরা এই সমস্যার ভুক্তভোগী।
কিন্তু ব্যাপারটা এটা যে শুধুমাত্র ব্রণের মত দেখতে হলেই যে সেটা ব্রণ তা কিন্তু নয় ।ত্বক সংক্রান্ত আরো অনেকগুলো সমস্যাই তো রয়েছে আমাদের।সেগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হতে পারে মেছতা,মিলিয়া,রোজাশিয়া,হাইপারপিগমেন্টেশন ইত্যাদি।এছারাও আরো রয়েছে ।
সব গুলোই যদিও ত্বক সংক্রান্ত অসুখ ; কিন্তু কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে।সেগুলো সম্পর্কে ভালো ভাবে জানা থাকলে এগুলোর প্রতিরোধ করতেও সুবিধা হয়।
তো চলুন তাহলে আজ আমরা জানবো যে ব্রণ,মেছতা,মিলিয়া,রোজাশিয়া হাইপারপিগমেন্টেশন সহ আরো কিছু স্কিন ডিসিজ নিয়ে যেগুলোকে আমরা অনেকসময় ব্রণের সাথে গুলিয়ে ফেলি । সবগুলোর মধ্যেকার পার্থক্যগুলো ভালোভাবে জানা থাকা রোগ সম্পর্কিত প্রতিরোধের জন্য অনেক জরুরি ।
প্রথমেই জানবো ব্রণ(একনি) নিয়ে।

১.ব্রণ(একনি) (Acne):
নামটি শুনতেই এক ধরনের বিভীষিকামতন মনে হয়।
একনি হলো একটি অতি পরিচিত ত্বকের সমস্যা যেখানে স্কীন অয়েল গ্ল্যান্ডগুলো থেকে অতিরিক্ত পরিমানে তেল নিঃসরিত হয়ে বা ধূলো ময়লার কারনে ত্বকের পোরস এর মুখ বন্ধ হয়ে ময়লা জমে আটকে যেয়ে ত্বকে গোটা মতন হয়,দাগ পড়ে যায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে গর্ত হয়ে যায়।
ব্রণের অনেকগুলো পর্যায় রয়েছে।
যেমন:হোয়াইটহেডস,ব্ল্যাকহেডস,প্যাপিউলস,প্যাশচুলস,সিস্টিক,নডিউলস ও এবসেস নামক পর্যায়।একেক পর্যায়ের সমস্যাগুলোও একেকরকম হয়।
ব্রণ হতে পারে গালে,মুখে,কপালে,নাকের দুপাশে,কাঁধে,পিঠে ইত্যাদি জায়গায়।
ব্রণ হওয়ার পেছনের ৩ টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ :
১.হরমোনাল চেঞ্জেস : পিউবার্টি,মেনোপজ,পিরিয়ডকালীন সময়গুলোতে হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে ব্রণ হয়।
২.ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ : প্রপাইনোব্যাকটেরিয়াম নামক ব্যাকটেরিয়া যদি কোন কারণে ত্বকে অধিক পরিমাণে জন্মানো শুরু করে তখন ত্বকে ব্রণ হয়।
৩.স্কিন প্রডাক্টস, স্ট্রেস,অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং অপর্যাপ্ত ঘুম: নানা ধরনের কেমিক্যালযুক্ত কসমেটিক সামগ্রীর দীর্ঘ ব্যাবহার,তেলেভাজা পোড়া এবং ঝাল মশলাদার খাবার, স্বল্প ঘুমের কারণেও ত্বকে ব্রণের আক্রমণ হয়।
প্রতিকার :
সঠিক ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস,নিয়মিত ত্বকের যত্ন,নন অয়েলি,নন কমেডোজেনিক ও ন্যাচারাল প্রডাক্ট ব্যাবহার,মানসম্মত ঘুম এবং সর্বোপরি চিকিৎসকের সাহায্যে ব্রণ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব।
২.মেছতা(Melasma):
মেছতা হলো ত্বকের এমন একটা রোগ যেখানে মুখের বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়ে যায়।এই দাগগুলো অনেক জেদি হয় এবং সহজে এগুলো থেকে নিস্কৃতি পাওয়া যায় না।
এটা পুরুষদের চেয়ে নারীদের বেশি হয় তুলনামুলক।
অনেক কারণের মধ্যে মেছতা হবার প্রধান ৩ টি কারণ হলো:
১.জন্মনিয়ন্ত্রন পিল গ্রহন করা:
দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রন পিল গ্রহন করতে থাকলে মেছতা হতে পারে।
২.সন্তান প্রসবের পরে: প্রসবোত্তর সময়ে অনেক শারীরিক পরিবর্তনের কারণে মেছতা হয়।
৩.রৌদ্রে অনেক বেশি সময় থাকলে:সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্নি অনেক বেশি সময় ধরে ত্বকের সংস্পর্শে আসলে তখন মেছতার সমস্যা দেখা দেয়।পুরুষদের মুলত এই কারনেই বেশি মেছতা হয়।

প্রতিকার :
কিছু নিদ্রিস্ট ধরনের এসেন্সিয়াল অয়েল,সুষম খাদ্যাভ্যাস,সান প্রটেকশন, ন্যাচারাল ব্লিচিং এসবের মাধ্যমে মেছতার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
একান্তই যদি বেশি মাত্রায় সমস্যা হয় সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন তো হতেই হবে।
৩.মিলিয়া:(Milia):
আমাদের ত্বকের মৃত চামড়া গুলো যদি নিয়মিত পরিস্কার না করা হয় তখন এগুলো ত্বকের নিচে আটকে যায়।
ময়লা এবং অয়েল জমে যেয়ে তখন ফুসকুড়ির মত হয়ে কিছুটা শক্ত গোটা টাইপের হয়ে যায়।সাদাটে টাইপের শক্ত এই ফুসকুড়ি গুলোকেই মিলিয়া বলা হয়।
সাধারনত নবজাতকদের এই সমস্যাটা বেশি হয়ে থাকে। ।বড়দেরও এটা হয় মাঝে সাঝে।
চোখের নিচে,কপালে,নাকের দুপাশে এবং চিবুকে এই সমস্যাটা বেশি দেখা যায়।

প্রতিকার :
নিয়মিত ত্বক পরিস্কার করা,পর্যাপ্ত পানি ও সুষম খাদ্য গ্রহন,কেমিক্যাল সমৃদ্ধ উপাদানের মাধ্যমে তৈরী কসমেটিক সামগ্রী বর্জন এবং ন্যাচারাল উপাদানের সঠিক স্কিনকেয়ার এবং সবশেষে চিকিৎসকের সহায়তায় মিলিয়া দূর করা সম্ভব।
মিলিয়া হওয়ার ৩ টি প্রধান কারণ হলো:
১.বংশগত ইতিহাস:
বংশে যদি এই রোগটি হবার ইতিহাস থাকে তাহলে মিলিয়া হতে পারে।এটাকে কিছুটা বংশগত রোগও বলা যায়।
২.স্কিন ডিসঅর্ডার:
একজিমা,সোরিয়াসিস,কেরাটোসি পিলারিস নামক রোগ হলে তখন মিলিয়া হতে পারে।
৩.লং টাইম সূর্যালোকের সংস্পর্শে থাকা:
দীর্ঘসময় সূর্যের আলোতে থাকলে ত্বক ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে মিলিয়া হতে পারে।
৪.রোজাশিয়া:(Rosacea):
রোজাশিয়া এমন ধরনের একটা ত্বকের সমস্যা যেখানে লালচে টাইপের পিম্পলের মত হয়। এগুলোত জ্বালাপোড়া করে,চুলকানি হয় এবং ফুলে ফুলে ওঠে।এমনকি রক্তনালিগুলোও দেখা যায় মাঝে মধ্যে এমনটা হলে।

রোজাশিয়া হওয়ার প্রধান ৩ টি কারণ:
১.ডিমোডেক্স মাইটস: বিভিন্ন গবেষণায় এটা এসেছে যে ডিমোডেক্স মাইটস নামক এক প্রকার অতি খুদ্র পরজীবি যা এমনিতেই আমাদের ত্বকে বসবাস করে,সেই ডিমোডেক্স মাইটস যদি কোন কারণে অতিরিক্ত হারে বংশবৃদ্ধি করে তাহলে এই রোজাশিয়া হয়ে থাকে।
২.মাইক্রোঅর্গানিজমস:
কিছু নিদ্রিস্ট ধরনের মাইক্রোঅর্গানিজমসের মধ্যে ব্যাকটেরিয়াম হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি নামক মাইক্রোঅর্গানিজম যদি কোন কারণে অতিরিক্ত হারে বংশবৃদ্ধি শুরু করে তাহলে এই রোজাশিয়া রোগের সংক্রমণ ঘটে থাকে।
৩.পরিবেশগত কারণসমূহ:
অতিরিক্ত সময় সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্নির সংস্পর্শে থাকা,তাপমাত্রার পরিবর্তন,অতিরিক্ত বাতাসে বেশি সময় থাকা,মাত্রাতিরিক্ত দূশ্চিন্তাও এই রোগের জন্য দায়ী।
প্রতিকার :
রোজাশিয়া হয়েছে এরকমটা বুঝতে পারলে সরাসরি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহন করে রোজাশিয়া সারানোর চেস্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
৫.হাইপারপিগমেন্টেশন : (Hyperpigmentation):
হাইপারপিগমেন্টেশন হলো স্কিনের এমন একটা অবস্থা যেখানে মেলানিন উৎপাদন বেড়ে যেয়ে ত্বকের ওপরিভাগ অতিরিক্ত পরিমানে কালো হয়ে যায়।কালো হয়ে যেয়ে জায়গাগুলোতে ছোপ ছোপ দাগ মতন পড়ে যায়।
হাইপারপিগমেন্টেশন হওয়ার জন্য দায়ী অন্যতম ৩টি কারণ হলো:
১.হরমোনাল : বিভিন্ন কারণে হরমোনাল ইমব্যালেন্স হলে এই সমস্যাটা হয়।
বিশেষ করে প্রেগন্যান্সিকালীন সময়ে হওয়া হরমোনের পরিবর্তনের তারতম্যের দরূণ এই হাইপারপিগমেন্টেশন ঘটে।
২.কিছু নিদ্রিষ্ট ঔষধ:
কিছু নিদ্রিষ্ট ধরনের ঔষধ যেমন টেট্রাসাইক্লিন জাতীয় এন্টিবায়োটিক দীর্ঘদিন সেবন করলেও হাইপারপিগমেন্টেশনের সমস্যা হয়।
৩.সান এক্সপোজার এবং এজিং:
কোন কারণে যদি দিনের বেশির ভাগসময়টাই সূর্যরশ্নির সংস্পর্শে কাটাতে হয় সেক্ষেত্রে মেলানিন উৎপাদন বেশি হয় এবং হাইপারপিগমেন্টেশনের সমস্যাও বেড়ে যায়।
এছাড়া যত বয়স হবে ততই ত্বকে মেলানিন উৎপাদন বাড়বে এবং হাইপারপিগমেন্টেশনের সমস্যাও বাড়বে।

প্রতিকার :
যতটা সম্ভব সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্নি থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা,পুস্টিকর খাবার দাবার খাওয়া,সঠিক নিয়মে ত্বকের যত্ন নেয়া এবং সর্বোপরি চিকিৎসকের সহায়তা নিয়ে হাইপারপিগমেন্টেশন থেকে সুরক্ষিত থাকা সম্ভব।
৬.একনি স্কারস:(Acne Scars):
ব্রণ(একনি) সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যতম আরেকটা স্কিন ডিসিজ হলো এই একনি স্কারস।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ব্রণের সমস্যা হয়তো সমাধান হয়েছে কিন্তু ত্বকে রয়ে গিয়েছে
অনেক দাগ ছোপ যা সহজে যাচ্ছেই না।
এগুলো ক্রমে ক্রমে ত্বককে করে তুলছে বিবর্ণ ,কালচে এবং নিস্প্রভ।

১.ব্রণ বা পিম্পল নখ দিয়ে খোঁচানো:
আমরা অনেকেই নিজের অজান্তে ব্রণ বা পিম্পলের ওপর চুলকাতে যেয়ে বা এমনিতেও দেখা যায় যে নখ লাগিয়ে ফেলি বা খুঁটি।এতে করে দাগ বসে যায়।
২.অনেক বেশি মাত্রায় ইনফেক্টেড হলে:
ব্রণ বা পিম্পল অনেক বেশি মাত্রায় ইনফেক্টেড হয়ে গেলে ত্বক নিজের সুরক্ষার জন্য অত্যধিক মাত্রায় কোলাজেন উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়।এতে করেও ব্রণের দাগ আরো একটু বেশি মাত্রায় গেড়ে বসে যায়।
৩.বেশি মাত্রার জ্বালাপোড়া হলে:
অনেকের ব্রণ হলে ত্বকে জ্বালাপোড়ার পরিমাণ এত বেড়ে যায় যে তাতে করে জ্বালাপোড়ার মাধ্যমে ইনফেকশন হয়ে নিজে থেকেও দাগ হয়ে যায়।
প্রতিকার : একনি স্কারস সহজে যায়না যদিও।তারপরেও নানারকম প্রাকৃতিক ও ভেষজ উপাদানের সঠিক ব্যবহার এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মেডিকেশন এর সমন্বয়ে আস্তে আস্তে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ সম্ভব।
৭. কোল্ড সোরস:(Cold sores):
অনেক সময় আমাদের ঠোঁটেও ব্রণের মত হয়।কিন্তু সবসময়ই যে সেটা ব্রণ ই হবে তাও কিন্তু নয়।এটা ঠান্ডাজ্বরের কারণে হওয়া ফোসকাও হতে পারে।কিন্তু এটা ব্রণ নাকি ঠান্ডাজ্বরজনিত ফোসকা কিনা এটা বোঝার জন্য কিছু নিদ্রিষ্ট উপায় রয়েছে।

যেমন, ব্রণ ত্বকের যেকোন জায়গাতেই হতে পারে।কিন্তু কোল্ড সোরস সাধারণত নিচের ঠোঁটে হয়।
আর ঠান্ডাজ্বরজনিত ফোসকাতে চুলকানি,জ্বলতে থাকার মত ভাব এবং ভেতরে খচখচ করছে এমন অনুভূত হবে।
ব্রণে মূলত হোয়াইটহেডস বা ব্ল্যাকহেডস
ব্যাপারটা ঘটে থাকে।আর কোল্ডো সোরস এ অনেকগুলো ছোট ছোট ফোসকা একত্রিত হয়ে বড় বা মাঝারি আকারের ফোসকা পড়ে।
এখন স্বাভাবিক দৃস্টিকোণ থেকে কোল্ড সোরস কে যতটা সহজ একটা রোগ বলে মনে হচ্ছে বাস্তবিক অর্থে ততটা সহজ নয়।
এটা হতে পারে হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসের আক্রমনের কারণেও। সংক্ষেপে HSV নামক এই ভাইরাসটির আক্রমন দুভাবে হয়ে থাকে। HSV 1 এর আক্রমণ হলে সেটা হয় কোল্ড সোরস এর মাধ্যমে। আর HSV 2 এর আক্রমণ হয় জেনিটালস এ আক্রমণের মাধ্যমে এবং খুবই সম্ভাবনা রয়েছে যে এটা পরবর্তিতে HIV সংক্রমণ এর দিকে যাবে।
তাই কোল্ড সোরস কে ব্রণ ভেবে আরামে বসে থাকার উপায় নেই।লক্ষণগুলো মিলে গেলেই যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
ব্রণ তো একটা ভয়াবহ সমস্যার ব্যাপার তা তো আমরা জানি।শারিরীক সৌন্দর্যের পাশাপাশি মনোজগতেও অনেকটা প্রভাব ফেলে এই ব্রণ।
কিন্তু ত্বকের সব সমস্যাকেই আবার ব্রণ ভেবে ভুল চিকিৎসা করলে সেটাও আমাদের জন্য ভালো ফলাফল দেবে না।তাই ভালোভাবে জানতে হবে যে রোগ আসলে কোনটা কি।
কারণ ওই যে কথায় বলে,সমস্যা ধরতে পারলেই অর্ধেক সমাধান সেখানেই হয়ে যায়।তাই আমাদেরকে ভালোভাবে জানতে হবে যে কোনটা ব্রণ আর কোনটা ব্রণ নয়।
সঠিক ভাবে জানা থাকলে তখন সেটার সমাধানের পথও অনেকটাই ইজি হয়ে যায়।

আজ এ পর্যন্তই।সবাই ভালো থাকুন সুস্থতার সাথে।
Leave a comment