বর্ষাকাল প্রকৃতির বর্ষায় একনির প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে, জেনে নিন সমাধান।

বর্ষাকাল প্রকৃতির জন্য যতটা প্রশান্তি বয়ে আনে, ত্বকের জন্য ঠিক ততটাই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে। এই সময়ে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বাড়ে, ঘাম বেশি হয়, ধুলো-ময়লা জমে এবং ত্বকের ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায়। আর এর ফলেই একনি বা ব্রণ দেখা দেয় হঠাৎ করেই। বিশেষ করে সংবেদনশীল ও তৈলাক্ত ত্বক যাদের, তাদের সমস্যাটা আরও প্রকট হয়ে উঠে।

এই লেখায় আমরা জানবো বর্ষায় কেন একনি বেড়ে যায়, কী কী অভ্যাস একনিকে বাড়িয়ে তোলে এবং ঘরোয়া ও চিকিৎসা পদ্ধতিতে কীভাবে আপনি এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

 

বর্ষায় একনি বেড়ে যাওয়ার কারণ

 

১. বাতাসে অতিরিক্ত আর্দ্রতা:

বর্ষাকালে পরিবেশে আর্দ্রতা অনেক বেড়ে যায়, যার ফলে ঘাম জমে এবং ত্বকে ধুলো-ময়লার সঙ্গে মিশে ছিদ্র বন্ধ করে ফেলে। এতে ত্বকের সেবাম বা প্রাকৃতিক তেল বের হতে না পারায় ব্রণ তৈরি হয়।

 

২. বারবার মুখ ধোয়া এবং ভুল ক্লিনজার ব্যবহার:

অনেকে ভাবেন ঘন ঘন মুখ ধুলেই ত্বক পরিষ্কার থাকবে। কিন্তু এতে ত্বকের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট হয় এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে ত্বক আরও বেশি তেল তৈরি করে, যা একনিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। 

 

৩. ভুল ধরনের স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট:

বর্ষায় অনেকে ভারী ক্রিম বা অয়েল বেসড ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করেন, যা ছিদ্র বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া অতিরিক্ত মেকআপও ব্রণ সৃষ্টি করে। তাই বর্ষাকালে হালকা বেজড মেকআপ ব্যবহার করুন।

 

৪. অপরিষ্কার তোয়ালে, বালিশের কভার:

ভেজা তোয়ালে বা ঘামে ভেজা বালিশের কভার নিয়মিত পরিষ্কার না করলে তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মায়, যা সহজেই ত্বকে সংক্রমণ ঘটায় এবং একনির কারণ হয়।

 

বর্ষায় একনি প্রতিরোধে যা করবেন

 

১. সঠিক ক্লিনজার ব্যবহার করুন:

তৈলাক্ত ও মিশ্র ত্বকের জন্য জেল ভিত্তিক স্যালিসাইলিক অ্যাসিড বা টি ট্রি অয়েলযুক্ত ক্লিনজার ব্যবহার করতে পারেন। এটি ত্বকের ছিদ্র খুলে রাখে এবং জীবাণু ধ্বংস করে।

 

২. টোনার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করুন:

বর্ষাকালে টোনার খুবই কার্যকর। এটি ছিদ্র ছোট করে, ত্বক ফ্রেশ রাখে এবং ব্রণ কমায়। অ্যাপল সিডার ভিনেগার, গুলাবজল বা উইচ হ্যাজেল জাতীয় প্রাকৃতিক টোনার ব্যবহার করা যেতে পারে।

 

৩. লাইটওয়েট ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন:

অয়েল-ফ্রি ও নন-কমেডোজেনিক ময়েশ্চারাইজার বেছে নিন। এটি ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখবে, কিন্তু ছিদ্র বন্ধ করবে না।

 

৪. সানস্ক্রিন ব্যবহার করবেন অবশ্যই:

অনেকে ভাবেন বর্ষায় সানস্ক্রিনের দরকার নেই। কিন্তু আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি তো বর্ষাতেও থাকে। তাই অয়েল-ফ্রি জেল বেসড সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।

 

৫. ব্যাকটেরিয়া দূর করতে মাস্ক ব্যবহার করুন:

সপ্তাহে অন্তত ২ দিন মুলতানি মাটি, নিমপাতা বাটা, চন্দনের গুঁড়া অথবা অ্যালোভেরা জেল দিয়ে মাস্ক ব্যবহার করুন। এগুলো ত্বক ঠান্ডা রাখে, ছিদ্র পরিষ্কার করে এবং ব্রণ শুকিয়ে দেয়।

 

একনি হলে কী করবেন না

 

  • ব্রণ হাত দিয়ে খোঁটাবেন না: এতে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে এবং দাগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • অতিরিক্ত স্ক্রাবিং করবেন না: ত্বকে জ্বালা ও লালচে ভাব বাড়িয়ে তোলে।
  • ঘন ঘন প্রসাধনী পরিবর্তন করবেন না: এতে ত্বক কনফিউজড হয়ে পড়ে এবং প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
  • ভেজা মুখে মেকআপ ব্যবহার করবেন না: এতে ছিদ্র বন্ধ হয়ে ত্বক নিঃশ্বাস নিতে পারে না, ফলে ব্রণ হয়।

 

একনি প্রতিরোধে কিছু ঘরোয়া উপায়

 

১. নিমপাতা ও মধুর প্যাক:

নিমের ব্যাকটেরিয়া নাশক গুণ আছে আর মধু ত্বককে শান্ত করে। এই দুটো মিশিয়ে ব্রণের জায়গায় লাগিয়ে ২০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।

 

২. অ্যালোভেরা জেল:

প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান হিসেবে কাজ করে। দিনে ২ বার ব্যবহার করুন।

 

৩. লেবুর রস ও মধু:

লেবু ত্বকের অতিরিক্ত তেল শোষণ করে আর মধু ত্বককে হাইড্রেটেড রাখে।

 

৪. বরফ ম্যাসাজ

ব্রণের ওপর দিনে ২-৩ বার বরফের টুকরো দিয়ে ম্যাসাজ করলে ব্রণের ফোলাভাব ও ব্যথা কমে।

 

চিকিৎসকের পরামর্শ কখন জরুরি

 

  • ব্রণ যদি পুঁজযুক্ত হয় এবং ব্যথা করে
  • একনি হরমোনজনিত মনে হয় (যেমন: পিরিয়ডের সময় বেশি হয়)
  • ঘরোয়া চিকিৎসায় উন্নতি না হলে
  • ত্বকে দাগ ও গর্ত পড়ে গেলে

 

এই ধরনের সমস্যায় ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক ক্রিম, রেটিনয়েডস বা হরমোনাল থেরাপি নেয়া যেতে পারে।

 

সুস্থ ত্বকের জন্য প্রতিদিনের অভ্যাসে আনুন পরিবর্তন

 

  • পর্যাপ্ত পানি পান করুন
  • পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিন
  • ফাস্ট ফুড ও অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া কমান
  • নিয়মিত এক্সারসাইজ করুন
  • পরিষ্কার তোয়ালে ও বালিশের কভার ব্যবহার করুন
  • বাইরে থেকে এসে ভালোভাবে মুখ পরিষ্কার করুন

 

বর্ষায় ত্বকের যত্ন হোক আপনার আত্মবিশ্বাসের অংশ

 

বর্ষাকাল আমাদের প্রকৃতির জন্য যেমন স্বস্তির সময়, তেমনি ত্বকের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং মৌসুম। এ সময় একটু অবহেলা করলেই ত্বকে দেখা দেয় একনি, ফুসকুড়ি ও নানা রকমের সংক্রমণ। কিন্তু এই সমস্যা যদি শুরুতেই চিনে ফেলা যায় এবং সঠিক যত্ন নেওয়া হয়, তবে তা খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।স্মরণ রাখতে হবে, ত্বক আমাদের সৌন্দর্যের বাইরের প্রতিফলন নয় শুধু এটি আমাদের স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা ও লাইফস্টাইলেরও আভাস দেয়। তাই একনির মতো সমস্যা হলে লুকিয়ে না রেখে, নিয়মিত পরিচর্যার মাধ্যমে তা দূর করার চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।বর্ষার ভেজা আবহে আপনার ত্বকও যেন সতেজ, উজ্জ্বল ও জীবন্ত থাকে সেজন্য প্রতিদিনের রুটিনে ছোট ছোট পরিবর্তন আনুন। সঠিক প্রোডাক্ট ব্যবহার করুন, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন এবং নিজের প্রতি ভালোবাসা থেকে প্রতিদিন একটু করে যত্ন নিন। একনি তখন আর সমস্যাই থাকবে না, বরং হবে সচেতন রুটিনের একটি সাময়িক প্রতিবন্ধকতা মাত্র।

 

সুস্থ ত্বক মানেই আত্মবিশ্বাসী আপনি—সেই আত্মবিশ্বাসেই হোক আপনার প্রতিদিনের শুরু, বর্ষাকালেও।

Author